গৃহায়ণের কোটিপতি চেইনম্যান

চাকরি নেই। গুরুতর অপরাধে গুরুদণ্ডে হয়েছেন চাকরিচ্যুত। কিন্তু তাতে কী। দিব্যি বহাল তবিয়তে এখনো জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে তার নিত্য আসা-যাওয়া। আছেন সেই আগের মতো। সহকর্মীরা সবই জানেন।

কিন্তু অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ায় কেউ তাকে নিয়ে ঘাঁটাতে চান না। তার মূল পদ চেইনম্যান। এরপর এমএলএসএস বা অফিস সহায়ক ছিল তার শেষ পদ। কিন্তু তাতে কী।

অনেকে তাকে স্যার বলে এখনো সম্বোধন করেন। পদ পিয়নের হলে কখনো তাকে সে দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। অফিস করেছেন রীতিমতো রাজার হালে।

অতি সৌভাগ্যবান এই কর্মচারীর নাম মুজিবর রহমান। খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) চেইনম্যান পদে তার নিয়োগ হলেও সেখানে দায়িত্ব পালন করেন সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে। তবে সুচতুর ও করিৎকর্মা মুজিবরের জীবন সেই বৃত্তে থেমে থাকেনি।

কেডিএর প্লট বাণিজ্য করে অল্প দিনে পান বড় সাফল্য। এরপর চলে আসেন লাইমলাইটে। ওই সময় তার এই দুর্নীতির পারদ এতটা উপরে উঠে যায় যে ওয়ান ইলেভেন সরকারের একশ’ দুর্নীতিবাজের তালিকায় তিনি প্রথমদিকে স্থান পেয়ে যান।

তবে রহস্যজনক কারণে তাকে শাস্তির পরিবর্তে দেওয়া হয় প্রাইজপোস্টিং। শাস্তিমূলক বদলি দেখিয়ে পদায়ন করা হয় ঢাকায়। পোস্টিং হয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের এমএলএসএস পদে। যারা এমন আদেশ দিয়েছিলেন, তারা হয়তো ভেবেছিলেন মুজিবর আর দুর্নীতি করার সুযোগ পাবে না।

কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে অল্পদিনের মধ্যে তিনি নিজ যোগ্যতায় এই দপ্তরের প্রথমসারির তদবিরবাজ কর্মচারীতে পরিণত হয়ে যান। রাজধানীতে আরও মূল্যবান প্লট বরাদ্দের তদবিরে যুক্ত হয়ে রীতিমতো আলাদীনের চেরাগ পেয়ে যান তিনি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সূত্র জানায়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হলেও মুজিবর রহমান অঢেল সম্পদের মালিক। অফিসে আসেন ব্যক্তিগত গাড়িতে। ধনাঢ্য লোক হিসাবে অফিসের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে তিনি বিশেষ সমাদরও পান।

এছাড়া তিনি কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) রাজনীতিতেও সক্রিয়। এ সুবাদে মাঝেমধ্যে তিনি ক্ষমতার জানান দেন ভিন্ন মেজাজে। তার হম্বিতম্বিতে অফিসের পদস্থ কর্মকর্তারাও অনেক সময় তটস্থ থাকেন। বর্তমানে তিনি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের শেল্টারে এক রকম বেপরোয়া।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুজিবর রহমান সেগুনবাগিচায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে আসেন নিয়মিত। সকাল ৯টায় ঢোকেন। বের হন সন্ধ্যায়। কাজ শেষ করতে কখনো রাত হয়ে যায়।

যাতায়াতের সময় তিনি দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। যার একটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ ৩৬-০৩০৩৯ এবং অপরটি হচ্ছে ঢাকা মেট্রো-গ ২৬-৪৪০৬। দুটি গাড়ির জন্য তার সার্বক্ষণিক নিজস্ব চালক রয়েছে।

তিনি সপরিবারে ধানমন্ডিতে বসবাস করেন। ঠিকানা-ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর রোডে ৭৭ নম্বর বাড়ি। ভবনের তৃতীয় তলায় ২/এ ফ্ল্যাট মালিক হিসাবে পরিচিত মুজিবর। ফ্ল্যাটের মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।

এছাড়া তার রিয়েল স্টেট ব্যবসাও রয়েছে। স্ত্রী মিসেস লাভলীর নামে খোলা কোম্পানির নাম ‘লাভলী রিয়েল স্টেট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপার লিঃ। মোহাম্মদীয়া সুপার মার্কেটের ৭৯/৮০ নম্বর দোকানে খোলা হয়েছে কোম্পানির অফিস। এছাড়া মজিবুরের নামে-বেনামে একাধিক প্লট রয়েছে।

সূত্র বলছে, মুজিবরের দশা অনেকটা ‘অতি লোভে তাঁতী নষ্ট’ প্রবাদের মতো হয়েছে। ২০২০ সালের দিকে হঠাৎ তিনি রাজউকে পোস্টিং চেয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। প্রভাবশালী মহলের তদবিরের ফলে তার পোস্টিংও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যায়।

কিন্তু চাকরি সংক্রান্ত ফাইল উপস্থাপন করা হলে ঘটে বিপত্তি। দেখা যায়, মুজিবর রহমান মূলত খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) কর্মচারী। ঢাকায় তাকে সাময়িকভাবে সংযুক্ত করা হয়েছিল। গৃহায়নের নিজস্ব কর্মচারী না হওয়ায় তাকে রাজউকে পোস্টিং দেওয়া সম্ভব নয়।

পূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাগ বলেন, নথি দেখে মুজিবর সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। দেখা যায়, বিধিবহির্ভূতভাবে তিনি গৃহায়নে চাকরি করছেন। এর ফলে প্রশাসন শাখায় ফাইল আটকে যায়।

মুজিবরকে তার ‘মূল কর্মস্থলে পাঠানো হোক’ বলে ফাইলে নোট দেওয়া হলে বিপদে পড়েন যান মুজিবর। এরপর প্রাইজপোস্টিংঢের আশা ছেড়ে দেন। তবে ঢাকা ছাড়তে নারাজ তিনি।

এজন্য প্রভাবশালী মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন এক অতিরিক্ত সচিবের হস্তক্ষেপে সুবিধা করতে পারেননি মুজিবর। ২০১৯ সালের ২০ মে তাকে কেডিএতে পোস্টিং করা হয়।

সূত্র বলছে, টাকা আর ক্ষমতার দাপটে নিজের পদমর্যাদা ভুলে মুজিবর অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এ কারণে পোস্টিংয়ের পরও তিনি কর্মস্থলে যোগ দেননি। সরকারি আদেশ প্রাপ্তির পরও অন্তত ৯ মাস তিনি ঢাকায় জাতীয় গৃহায়নের কার্যালয় ছাড়েননি।

এক পর্যায়ে তার বেতন ভাতা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। পরে নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ায় তাকে বিধি অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি নোটিশের কোনো জবাবও দেননি।

এরপর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে বিভাগীয় মামলার রায়ে গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত হন মুজিবর। তাকে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে এ সংক্রান্ত আদেশের একটি কপি আসে। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর মুজিবরকে চাকরিচ্যুত করে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এ সংক্রান্ত আদেশে স্বাক্ষর করেন কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল মুকিম সরকার।

অফিস আদেশ অনুযায়ী চাকরিচ্যুতির প্রায় দু’বছর পূর্ণ হয়েছে। বিধি অনুযায়ী তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আবেদনও করেননি। ফলে সরকারি চাকরিতে তার পুনর্বহালের ন্যূনতম সুযোগও এখন আর অবশিষ্ট নেই। এমনটি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরখাস্তের পর কিছুদিন আড়ালে ছিলেন মুজিবর। এরপর ঠিক কবে থেকে তিনি ফের গৃহায়নে নিয়মিত যাতায়াত করছেন তার সঠিক দিন তারিখ কারো জানা নেই। অফিসের অনেকেই জানেন না তার চাকরিচ্যুতির খবর। আবার বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে যারা জানেন তারা মুজিবরের ক্ষতি চান না বলে মুখ বন্ধ রেখেছেন।

রোববার দুপুরে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে গিয়ে মুজিবরের খোঁজ করা হলে অভ্যর্থনা টেবিলের কর্মচারী সৌদিয়া খাতুন বলেন, ‘মুজিবর স্যার এখনো অফিসে আসেননি। কখন আসবে তা বলা যাচ্ছে না।’

এরপর বুধবার পুনরায় গৃহায়নে গেলে দেখা যায় মন্ত্রী-সচিবের অফিস পরিদর্শন উপলক্ষ্যে মূল গেটে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। মুজিবর অফিসে এসেছেন কি না জানতে চাইলে দপ্তরের রিসিপশনে কর্তব্যরত কয়েকজন কর্মচারী প্রথমে বলেন, ‘মুজিবর কে? তাকে চিনি না।

এই নামে এখানে কেউ নেই।’ ফের বলা হয়, চেইনম্যান মুজিবর। একটা কাজের জন্য উনার কাছে এসেছি। এরপর ওই অভ্যর্থনা টেবিলে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বলেন, ‘আজ হয়তো উনি অফিসে আসবেন না। ফোন করে দেখেন। পান কি না।’ তার মুঠোফোন নম্বর চাইলে প্রথমে তারা বলেন, তাদের কাছে নম্বর নেই। এরপর বলেন, দেওয়া যাবে না।’

চাকরিচ্যুতির পরও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে মুজিবর রহমান বুধবার বলেন, ‘তার একটি রিয়েল স্টেট কোম্পানি আছে। এ সংক্রান্ত কাজকর্ম নিয়ে সেখানে যাতায়াত করেন। তাছাড়া এক সময় তিনি সেখানে চাকরি করেছেন। ফলে অফিসে গেলে তো কেউ তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না।’

ধানমন্ডিতে কোটি টাকার ফ্ল্যাটের মালিকানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ‘ফ্ল্যাট তার নিজের নয়। এক আত্মীয় তাকে থাকতে দিয়েছে।’ নিজের ফ্ল্যাট না হলে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কীভাবে হলেন তা জানতে চাইলে মুজিবর রহমান বলেন, ‘এখানকার মালিকরা আমাকে করেছে। মালিক না হলে করা যাবে না-এমন কোনো নিয়ম নেই।’

একাধিক গাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এক সময় তিনি রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা করতেন। তখন থেকেই গাড়িগুলো আছে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে মুজিবর বলেন, ‘পূর্বাচল, উত্তরা অথবা কেডিএ’র এলাকায় তার কোনো প্লট নেই।’  সূত্রঃ যুগান্তর

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ