গণহত্যা-ধ্বংস-ক্ষুধা-বর্বরতার ২০০ দিন

আকাশে বুলেট-বারুদের ধোঁয়া। ঘুম থেকে উঠলেই সাইরেনের শব্দ। বাড়ির সামনে লিফলেট। ঘর ছাড়ার হুমকি। বিনা নোটিশে বোমা। পালানোর নেই পথ। বাতাসে লাশের গন্ধ। শহরের অলিগলিতে পাথর-কংক্রিটের মাঝে ছিন্নভিন্ন মরদেহ। একদিকে স্বজন হারানোর শোক অন্যদিকে পেটের ক্ষুধা। চিৎকার করার শক্তি ও চোখের পানি দুটোই যেন হারিয়ে গেছে গাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইলের অমানবীয় নৃশংসতায় মঙ্গলবার ছিল গাজা যুদ্ধের ২০০ দিন। আলজাজিরা।

৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইলের আগ্রাসনের মুখে পড়েছে গাজা। অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে বেড়েছে মৃত্যুমিছিল। হয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ২০০ দিনের বর্বরতায় গাজা উপত্যকায় ৭৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলেছে ইসরাইল সেনাবাহিনী।

অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে ৩৮০,০০০ হাউজিং ইউনিট, ৪১২টি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫৬টি মসজিদ, তিনটি গির্জা এবং ২০৬টি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থান ক্ষতিগ্রস্ত বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। এছাড়াও ভয়াবহ এ হামলায় মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলের তাণ্ডবে গাজার ৩২টি হাসপাতাল এবং ৫৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে এবং ১২৬টি অ্যাম্বুলেন্সকেও টার্গেট করা হয়েছে। গাজার মিডিয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলার।

গাজায় ইসরাইলের হামলা শুরুর পর থেকে নারী ও শিশুরাই ছিল তাদের মূল টার্গেট। ফিলিস্তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিঃশেষ করতে বদ্ধপরিকর ইসরাইলি সেনারা। আলজাজিরার তথ্যানুসারে গাজায় এখন পর্যন্ত নিহত নারীর সংখ্যা ১০,০০০ বেশি।

এদিকে যুদ্ধের সবচেয়ে সহজ ও নির্মম শিকার শিশুরা। প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে তারা। ইসরাইলের নৃশংসতায় গাজায় প্রাণ গেছে ১৪ হাজার ৬৮৫ শিশুর। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমকে সরব দেখা গেলেও এক মাস ধরে অজ্ঞাত কারণে তাদের সক্রিয়তা কমেছে। যেন বিশ্ব ভুলে গেছে এ নির্দোষদের, যারা বোমা, গুলি ও অনাহারে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ’র গণমাধ্যম উপদেষ্টা আদনান আবু হাসনা জানান, গাজায় শত শত শিশু এতিম হয়ে গেছে। গাজায় এখন ১৮ হাজার এতিম শিশুর বাস, যারা সবকিছুই হারিয়েছে পরিবার, আদর ও জীবন।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, প্রতি ১০ মিনিটে গাজায় একটি শিশু হতাহত হচ্ছে। এ কারণে দ্রুতই একটি যুদ্ধবিরতি দাবি করছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থাটি। তারা মনে করেন, কেবল যুদ্ধবিরতিই পারে সেখানে অব্যাহত শিশুমৃত্যু ঠেকাতে। এ নিয়ে একাধিকবার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হলেও কোনো সুরাহা করা সম্ভবনি। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এর বাইরে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় অনাহার-অপুষ্টিতে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে হাজার হাজার শিশু। অনেক শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। গাজায় পানি, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় দুর্ভোগের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা সংবাদ প্রচার করছেন তাদের সপরিবারে হত্যা করা হচ্ছে। ত্রাণপ্রত্যাশী ও ত্রাণকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে।

এদিকে ইসরাইলের হামলা থেকে বাঁচতে গাজার অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। শরণার্থী শিবিরে থেকেও ইসরাইলি বোমার শিকার হচ্ছে তারা। যুদ্ধের ২০০তম দিনেও কবে এই সংঘাতের অবসান হবে সঠিক তথ্য জানা নেই।

মঙ্গলবার এএফপির সংবাদদাতা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজার আশপাশের আল-তুফাহ, শুজাইয়া এবং জেইতুন এলাকায় রাতভর তীব্র গোলাবর্ষণ করেছে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিম গাজা এবং দক্ষিণে খান ইউনিসে গোলাবর্ষণ এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

এমনকি বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের কাছে বিমান হামলা এবং নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে আর্টিলারি ফায়ার চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। উত্তর গাজার বাসিন্দা এবং হামাস মিডিয়ার জানানো তথ্যমতে, গাজা উপত্যকার উত্তরপ্রান্তের বেইত হ্যানউনের পূর্বদিকে ইসরাইলি সেনা ট্যাংকগুলো নতুন করে হামলা শুরু করেছে। তবে সেগুলো এখনো শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। ট্যাংকের ছোড়া কয়েকটি গুলি বিদ্যালয়ে আঘাত হেনেছে। সেখানে গাজার বাস্তুচ্যুত বাসিন্দারা আশ্রয় নিচ্ছিলেন। ইহুদি হলিডে পাসওভার উপলক্ষ্যে ইসরাইলে সরকারি অফিস এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা ছিল। এর মধ্যে সোমবার শেষরাতে সেখানে রকেট হামলার সতর্কতা জারি করে ইসরাইল। একই সঙ্গে বন্ধ রাখা হয় দক্ষিণ সীমান্ত শহরগুলো। তবে এই হামলায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

এমনকি গাজার আল-শিফাসহ বড় বড় হাসপাতালে গণকবরেরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। ইসরাইলের হামলার ২০০ দিনে গাজায় নিহতদের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে এবং আহতদের সংখ্যা ৭৭ হাজারের বেশি। অন্যদিকে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধেও  প্রতিবাদে সরব হয়েছে ইসরাইলের বাসিন্দারা। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সেনাবাহিনী হামাসের হাতে বন্দি রয়েছে ইসরাইলের নাগরিকরা।

যুদ্ধবিরতির শর্তেই তাদের ছেড়ে দেবে হামাস। কিন্তু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির কোনো আশ্বাস না পাওয়ায় ভীষণ ক্ষেপেছে দেশটির নাগরিকরা। এমনকি তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দলন করছে তারা।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ