হাতের ব্যথা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের (ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) আউটডোরে চিকিৎসা নিতে গেছেন যুবক আবীর শিকদার। কর্তব্যরত চিকিৎসক ইউসুফ আলী সরকার জানালেন, তার হাতে টিউমার হয়েছে। এরপর তিনি সিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি প্যাথলজির স্লিপ বের করে বললেন, ‘এখান থেকে টেস্টগুলো করিয়ে আসেন’। ওই প্যাথলজিতে গিয়ে যুবক আবীর শিকদার জানতে পারলেন সব টেস্ট করতে মোট ২৩শ টাকা লাগবে।
ফের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসক ইউসুফ আলী সরকারকে বললেন, এই টেস্টগুলো হাসপাতালে সরকারি ফি দিয়ে করিয়ে দেওয়ার জন্য। উত্তরে ডা. ইউসুফ আলী জানালেন, ‘হাসপাতালের মেশিন ভালো না, পুরোনো। রেজাল্ট সঠিক আসবে না। যেখানে বলেছি সেখানেই করান, অন্য কোথাও করলে হবে না’। এরপর আবীর শিকদার হাসপাতালের আবাসিক অফিসার (আরএমও) ডা. শেখ ফরহাদের কাছে গিয়ে পুরো বিষয়টি জানালেন। আরএমও শেখ ফরহাদ যথারীতি ডা. ইউসুফ আলীকে ডেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাইলে পুরো বিষয়টিই অস্বীকার করেন তিনি।
এরপর আবীর শিকদার জানালেন, তিনি একজন গণমাধ্যম কর্মী এবং তার হাতে কোনো সমস্যা ছিল না। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্লিপ বের করে দেওয়ার প্রমাণ আছে তার কাছে। এরপর কয়েক মিনিট ওই কক্ষে পিনপতন নীরবতা চলছিল।
একই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। রোগীরা ভিতরে প্রবেশ করতেই তিনি দরজা লাগিয়ে দিচ্ছেন আর বের হচ্ছেন রোগীকে দেওয়া চিকিৎসাপত্র নিয়ে, সঙ্গে একেক সময় একেক প্যাথলজির স্লিপ নিয়ে। এমন ৩-৪টি ঘটনার পর ওই যুবককে নাম জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি হাসপাতালের স্টাফ নাকি দালাল? শুনেই ক্ষেপে গেলেন ওই যুবক। বললেন আমি রোগী নিয়ে এসেছি। কিন্তু এত রোগী কী করে তার আত্মীয় হয়ে গেল- জানতে চাইলে তিনি দিলেন ভোঁদৌড়। আশপাশের রোগী ও স্বজনরা জানালেন ওই যুবক এখানকার দালাল। নির্দিষ্ট ফার্মেসি আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী নিয়ে যাওয়াই তার প্রধান কাজ। এ ব্যাপারে জরুরি বিভাগে থাকা ডা. নাজমুলকে ওই যুবক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি কামরা থেকে উঠে চলে যান।
এভাবেই দেশের অন্যতম শীর্ষ রাজস্ব প্রদানকারী জেলা হলেও নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসাসেবার নামে চলছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য। খোদ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, সরকারি চিকিৎসক এবং বেসরকারি ক্লিনিক মালিকদের সমন্বয়ে চলছে এই সিন্ডিকেট। কারণ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই এখন নামে-বেনামে শহরের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর মালিক। সরকারি স্বাস্থ্য সেবার মান এই জেলায় এতটাই কম যে বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ ছুটছেন রাজধানীর দিকে, নয়তো প্রাইভেট ক্লিনিকে। বিশেষায়িত হাসপাতাল তো দূরে থাক সামান্য বুকের ব্যথা, আগুনে পোড়া রোগীদেরও ছুটতে হয় ঢাকায়। জেলার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল খানপুর ৩০০ শয্যা (প্রস্তাবিত ৫শ শয্যা) হাসপাতালের ৫০২টি পদের মধ্যে ১৪৯টি পদই খালি। করোনাকালে এই হাসপাতালটিকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রূপ দেওয়ায় পুরো চিকিৎসাসেবা নির্ভর হয়ে পড়ে সরকারি জেনারেলের (১০০ শয্যা বিশিষ্ট ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) ওপর।
কিন্তু এই হাসপাতালের দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য আর চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিক আর প্যাথলজির ব্যবসার কারণে জিম্মি রোগীরা। কোনো কোনো ডাক্তার সরাসরি এসব ক্লিনিক প্যাথলজির এজেন্ট হয়ে বসে আছেন এই হাসপাতালে। এ ২টি হাসপাতালে সরকারি রেটে প্যাথলজি (নিরীক্ষণ) এর সুযোগ থাকলেও শেষ কবে এখানে আলট্রাসনোগ্রাফি কিংবা জটিল কোনো রক্ত পরীক্ষা হয়েছে তা বলা দুস্কর।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তালিকা অনুযায়ী পুরো জেলায় ৪৭টি অবৈধ ক্লিনিক ও প্যাথলজি থাকলেও সেগুলো কী করে চলছে তার কোনো উত্তর স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে নেই। উপরন্তু বৈধ তালিকায় থাকা ক্লিনিক, প্যাথলজিগুলোর বৈধতা পাওয়ার অনেক শর্তই না থাকলেও কীভাবে বৈধতা পেল এমন প্রশ্নেরও উত্তর নেই স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই জেলায় বেসরকারি পর্যায়ে মোট বৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ও ব্লাডব্যাংকের সংখ্যা মোট ১৫৯টি । তবে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তালিকা অনুযায়ী পুরো জেলায় ৪৭টি অবৈধ ক্লিনিক ও প্যাথলজি থাকলেও পুরো জেলায় এই অবৈধ ক্লিনিক ও প্যাথলজির সংখ্যা কমপক্ষে দেড় শতাধিক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, একটি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ও ব্লাডব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স, আবস্থানগত ছাড়পত্র, পরিবেশগত ছাড়পত্র, অগ্নি নির্বাপন ছাড়পত্র ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ছাড়পত্র সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি জমা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করে লাইসেন্স নিতে হয়। তবে ক্লিনিক বা হাসপাতালের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্র্যাকটিস (ডিপ্লোমা) নার্স ও ২৪ ঘণ্টা একজন নূন্যতম এমবিবিএস চিকিৎসক থাকা বাধ্যতামূলক।
সেই সঙ্গে মেটার্নিটি ওয়ার্ড, জরুরি বিভাগ থাকার নিয়মও রয়েছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে যেসকল বৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ২-৩ জন ছাড়া বাকিরা ডিপ্লোমাধারী নন। পাশপাশি অধিকাংশ ক্লিনিকে দেখা মিলেনি জরুরি বিভাগের বা ইমার্জেন্সি ডাক্তারের। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবস্থা আরও বেশি খারাপ। অনেক ছোট ছোট ডায়াগনস্টিক সেন্টার পাওয়া গেছে যেখানে শুধু রোগীদের স্যামপল নেওয়া হয় এবং এগুলোর নিরীক্ষণ করা হয় অন্য কোনো সেন্টারে। গত ২ দিনে শহরের সরকারি জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, চরম অব্যবস্থাপনা আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার সরকারি ২টি হাসপাতালের এই ভগ্নদশার নেপথ্যে রয়েছেন ক্লিনিক মালিকরা। বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা সুযোগ বুঝে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন সরকারি চিকিৎসকদেরও। ফলে সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের পাঠানো হচ্ছে বেসরকারি সেবা নিতে।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা জানান, জ্বর-ঠাণ্ডা, কিংবা নাক দিয়ে পানি পড়া যেই কারণেই ডাক্তার দেখাবেন আগেই টেস্ট দিয়ে দিবে। অথচ হাসপাতালে কোনো টেস্ট নাই বললেই চলে। সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে আসলেও এক্সরে ও রক্ত পরীক্ষা দিচ্ছেন ডাক্তাররা। সঙ্গে কোথায় টেস্ট করাতে হবে সেই স্লিপও দিচ্ছেন ডাক্তার।
দুই বছরের কোলের শিশু নাদিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন তার বাবা নাজিম উদ্দিন (৩৬)। তিনি অভিযোগ করে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা দিয়া কী করব। এখানকার ডাক্তাররাই আমাদের সেখানে পাঠায় টেস্ট করাতে। আমাকে স্লিপ দিয়ে দিসে কোথায় টেস্ট করাতে হবে। আপনি অন্য কোথাও টেস্ট করালে এরা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না। এখানে তাদের ওই সেন্টার থেকে কমিশন আসার একটি বিষয় আছে। ডাক্তারদের এই কমিশন বাণিজ্যে আমরা রোগীরা অসহায় ও জিম্মি হয়ে আছি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবুল ফজল মোহাম্মদ মুশিউর রহমান জানান, ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে আড়াই বছর আলট্রাসনোগ্রাফি বন্ধ ছিল। আমি এসে সেটি চালু করেছি। সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা হচ্ছে না আমি এ বিষয়টি মানতে পারছি না। তবে সমস্ত পরীক্ষা হাসপাতালে করা সম্ভব না, সবাইকে করা সম্ভব না। আমরা চাই, যারা অল্পসংখ্যক টাকা নিয়ে হাসপাতালে আসেন তারা যেন সেবাটা পায়। তবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা কারা অবৈধভাবে হাসপাতাল পরিচালনা করছে শুধু এতটুকুই দেখছি। তবে আমরা নিয়মিত হাসপাতাল পরিচালনার সব দিক ঠিক আছে কিনা এবং নন-মেডিকেল পারসন দ্বারা সেবা দেওয়া হচ্ছে কিনা- এর সবই আমরা খেয়াল রাখছি।