পিকে হালদারের যত অপকর্ম

প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। তার বিরুদ্ধে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।বাংলাদেশের আর্থিক খাতের আলোচিত এই জালিয়াতকে আজ (১৪ মে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।

পিকে সিন্ডিকেটের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদক অদ্যাবধি ২২টি মামলা করেছে। অনুমোদিত ১৩টি হলে মামলা হবে ৩৫টি। মামলাগুলোতে ২ হাজার কোটি টাকার ওপর আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। অদ্যাবধি এসব মামলায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব মামলায় আদালত ৬৯ জনকে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এ ছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবরে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় আদালতে চার্জশিটও (অভিযোগপত্র) দেওয়া হয়েছে।

৪০ প্রতিষ্ঠানকে ২৫০০ কোটি টাকা ঋণ : ২০১০ সালে পিকে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি ছিলেন তখন রাশেদুল হক রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ডিএমডি ছিলেন।

পিকে হালদার যখন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন, রাশেদুল হক তখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হিসেবে ২০১৫ সালে যোগদান করেন।

এমডি হিসেবে যোগদান করেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রস্তাবের পরদিনই ঋণ দিয়ে দেন। এভাবে প্রায় ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন।

এসব ঋণের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো মর্টগেজ ছিল না। কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও নানাবিধ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণের নামে লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্যাপিটাল মার্কেটে সরিয়ে নিয়ে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

পিকে হালাদার এসব অপকর্মের বহু সহযোগী রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বড় একটি সিন্ডিকেট ছিল তার। পিকে হালদারের অপকর্মের সঙ্গে ছিল তার কয়েকজন বান্ধবীও। পিকে হালদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর নাম নাহিদা রুনাই। এই বান্ধবী পিকের অন্যতম সহযোগীও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত নাহিদা রুনাইয়ে বাড়ি চট্টগ্রামের খুলশী থানার পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকায়।  রুনাইয়ের বাবার নাম মফিজুর রহমান। তিনি চট্টগ্রামে একটি সরকারি দপ্তরে ‘করণিক’ পদে চাকরি করতেন।

নাহিদা রুনাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডে চাকরি পান।

চাকরির সুবাদে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয় পিকে হালদারের সঙ্গে। ২০০৯ সাল থেকে রিলায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন পিকে হালদার। ২০১২ সালের দিকে পিকের সঙ্গে পরিচয় রুনাইয়ের।  পিকে হালদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এত বেশি হয়ে যায় যে, তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এসএমই লোন শাখার অফিস এক্সিকিউটিভ থেকে প্রতিষ্ঠানপ্রধান পিকে হালদারের বান্ধবী ‘বড় আপা’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। পদ পেয়ে হয়ে যান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।

রুনাই ছাড়াও আরেকজন বান্ধবী আছে পিকে হালদারের। নাম সুভ্রা রানী ঘোষ। দুজনই গ্রেফতার হয়ে এখন কারাবন্দি। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পর দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা একে অপরকে প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদা রুনাই ও ওকায়ামা লিমিটেডের পরিচালক সুভ্রা রানী ঘোষ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পিকে হালদারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। তারা দুজনই পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত। তারা জালজালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন।

পিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা : পিকে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে ২০২১ সালের শুরুতেই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান।

প্রসঙ্গত, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুসহ সিন্ডিকেটের সহায়তায় কয়েকটি লিজিং কোম্পানি থেকে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরিয়ে পিকে হালদার দেশ থেকে সটকে পড়েন। এ অর্থের বড় একটি অংশ কানাডা, ভারত ও সিঙ্গাপুর পাচার করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা সরানো হয়।  এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় আরও প্রায় ৭৫০০ কোটি টাকা ঋণের নামে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেট।

সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২২০০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ২৫০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেখিয়ে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ