অভিবাসন আইন প্রয়োগে বহুমুখী কৌশল নিচ্ছেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পর অভিবাসীদের ওপর আরও বেশি কঠোর নীতি নিয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা মানসিক ও আর্থিক চাপের মুখে পড়েছেন। গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট পাস হয়। এতে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। পরে ধাপে ধাপে অভিবাসন আইন প্রয়োগে বহুমুখী কৌশল বেছে নেন ট্রাম্প।

অভিবাসীদের চাপে রাখতে ট্রাম্প আইনটির মাধ্যমে ‘রেমিট্যান্স-কর’ আরোপের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। অভিবাসন আইন প্রয়োগে ট্রাম্প এখন নতুন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। সর্বশেষ সব ধরনের আশ্রয় আবেদনের সিদ্ধান্ত স্থগিতও করা হয়েছে। ইরানসহ ১৯ দেশকে কালো তালিকায় ফেলা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্প তার নির্বাচন প্রতিশ্রুতি পূরণে ‘বৃহত্তম অভ্যন্তরীন নির্বাসন অভিযান’ শুরু করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম। এর অংশ হিসেবে দেশব্যাপী অভিযান চালিয়ে অভিবাসীদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যগতভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী নীতির সমালোচনা করেছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা। তাদের ভাষ্য, ট্রাম্প প্রশাসনের আক্রমণাত্মক কৌশল অভিবাসীদের যথাযথ সুরক্ষা প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ণ করেছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প তার ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন বলেও তাদের মত।

অভিবাসন সংক্রান্ত বড় ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ১৯ দেশকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় ট্রাম্প দেশগুলোর অভিবাসীদের গ্রিন কার্ড পর্যালোচনার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে অভিবাসীদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র এখন উদ্বেগজনক দেশ।

দেশগুলো হলো- আফগানিস্তান, মিয়ানমার, শাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ইয়েমেন, বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলা।

গত ২৬ নভেম্বর রহমানউল্লাহ লাকানওয়াল নামে একজন আফগান নাগরিক ওয়াশিংটনে দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যকে গুলি করে। এর পরই ট্রাম্প প্রশাসন ওই ১৯ দেশকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
অনিশ্চয়তায় ২ লাখ ইউক্রেনীয়

ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দুই লাখ ইউক্রেনীয় আইনি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, জো বাইডেনের চালু করা মানবিক কর্মসূচি প্রক্রিয়াকরণে ট্রাম্প প্রশাসনের বিলম্বের ফলে এই সংকট তৈরি হয়েছে।

রয়টার্স দুই ডজন ইউক্রেনীয়ের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা স্ট্যাটাস নবায়ন প্রক্রিয়াকরণে বিলম্বের কারণে তাদের ওয়ার্ক পারমিট এবং চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রযুক্তি কর্মী, স্কুল শিক্ষক, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার এবং কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন।

অভিবাসন আইন প্রয়োগে নানা কৌশল

১৮৯১ সালের অভিবাসন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত হয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এই আদেশকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। তারা এমন একটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা একাধিক ফেডারেল সংস্থাকে আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়।

আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের নীতি পরিচালক নয়না গুপ্তা মনে করেন, আমরা ট্রাম্প প্রশাসনের যে পদক্ষেপ দেখছি, তা মূলত গণনির্বাসন এজেন্ডা বাস্তবায়নের কৌশল।

ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ মার্কিন সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সেখানে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে আদালতের শুনানি ছাড়াই অনথিভুক্ত অভিবাসীদের নির্বাসন করার অনুমতি পাচ্ছেন অভিবাসন কর্মকর্তারা। শত শত অভিবাসীকে বহিষ্কার করে বিমানের মাধ্যমে গণনির্বাসন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

অন্যদিকে অভিবাসন আইন প্রয়োগের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থার কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়েছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সীমান্ত অপরাধ মোকাবেলায় পঞ্চাশটি রাজ্যে টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে আটক ও বহিষ্কার অভিযানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এ কাজ বাস্তবায়নে কয়েক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ট্রাম্প অভিবাসন আইন প্রয়োগের পরিধিও বাড়িয়েছেন। জো বাইডেন ও বারাক ওবামা প্রশাসনের নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাদের অধীনে অপরাধমূলক রেকর্ড পর্যালোচনা করা হতো। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত ব্যক্তিদেরই কেবল অপসারণের নিয়ম ছিল।

আইন বিশেষজ্ঞ গুপ্তা সতর্ক করছেন, অভিবাসন নীতি পুনর্গঠনে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহারের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, ১৭৯৮ সালের এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্টের মতো শতাব্দি প্রাচীন আইন প্রয়োগ মূলত ট্রাম্পের কর্তৃত্ব ফলানোর একটা উপায়।

আইসিইর ভূমিকায় পরিবর্তন

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের বৃহত্তম তদন্তকারী শাখা হিসাবে আইসিই যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ফেডারেল আইন প্রয়োগ করে থাকে। এই বিভাগ প্রধানত মার্কিন কাস্টমস, অভিবাসন এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইসিইর ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইসিই শুধু অভিবাসন আইন প্রয়োগ নয়, এখন বিভাগটি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কাস্টমস এবং সীমান্ত সুরক্ষার কাজও করছে। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক ক্যাথলিন বুশ-জোসেফ বলেন, অভিবাসী আইন প্রয়োগে ট্রাম্প প্রশাসন মূলত বাইডেন প্রশাসনের বিপরীত অবস্থান নিয়েছে।

গত মে মাসে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার নিশ্চিত করেন, ট্রাম্প প্রশাসন দৈনিক তিন হাজার অননুমোদিত অভিবাসীদের গ্রেপ্তারের কোটা নির্ধারণ করেছে।

সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র ট্রানজ্যাকশনাল রেকর্ডস অ্যাক্সেস ক্লিয়ারিং হাউসের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পঁয়ষট্টি হাজারেরও বেশি অভিবাসীকে আটক বা নজরদারিতে রেখেছে আইসিই। গত সেপ্টেম্বরে জর্জিয়ার সাভানাতে একটি হুন্ডাই বৈদ্যুতিক যানবাহন কারখানার পাঁচ শতাধিক কর্মীকে আটক করা হয়, যাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক।

বিচারকের ওয়ারেন্ট ছাড়াই অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রয়োগ দেখাচ্ছে আইসিই। বাইডেন প্রশাসনের প্রাক্তন আইসিই চিফ অফ স্টাফ জেসন হাউসারের মতে, সংস্থার আইনি কর্তৃত্ব নিয়ে সমস্যা নয় বরং সেই কর্তৃত্ব কীভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

সান দিয়াগো শহরের চিত্র আগের মতো নেই

ট্রাম্পের কঠোর নীতি গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তবর্তী ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়াগো শহরের পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। সান দিয়াগোর ট্রমা সার্জন ডা. বিশাল বনসাল বলেন, আগে প্রায়ই দেখা যেত, সীমান্তের সুউচ্চ প্রাচীর থেকে অভিবাসন প্রত্যাশীরা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে লাফিয়ে পড়ছে। সেই দৃশ্য এখন আর দেখা মেলে না। পায়ের গোড়ালি কিংবা হাড় ভাঙ্গা অবস্থায় তাদের হাসপাতালে আনা হতো। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই অবস্থা এখন আর নেই। হাসপাতালের বেড এখন খালি দেখা যায়।

মার্কিন কাস্টমস এবং সীমান্ত সুরক্ষা পরিসংখ্যান অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ১৯৭০ সালের পর থেকে অভিবাসী প্রবেশ সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। সান দিয়াগো ও টিজুয়ানার (মেক্সিকোর শহর) মধ্যে করিডোরটিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।

সূত্র: কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস, বিবিসি ও রয়টার্স।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ