দেশের বৃহত্তম সিনেমা হল ‘মণিহার’। যশোরে অবস্থিত হলটিকে এক সময় মনে করা হতো এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ; তখন মণিহারও ছিল সিনেমাপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রে। রাজধানী থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পর্যন্ত ছুটে আসতেন মণিহারের পর্দায় নিজের সিনেমার দেখতে। কিন্তু বাণিজ্যিক সিনেমার অভাবে হলটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
হল কর্তৃপক্ষ জানান, দর্শক চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসাসফল সিনেমা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ক্রমাগত গুনতে হচ্ছে লোকসান। এমন অবস্থায় হলের কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।
১৯৮৩ সালে যাত্রা করে মণিহার সিনেমা হল। সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করলেও ৪২ বছরের পুরনো স্থাপনা এখনই ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা নেই বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার সিনেমা হলটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কলকাতার ‘অভিমান’ সিনেমার শো’ চলছে। আর সিনেপ্লেক্সে চলছে সালমান শাহর ‘বিক্ষোভ’।
মণিহারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মিঠু বলেন, অভিমান সিনেমা আগেও চারবার চালিয়েছি। একেতো নতুন ছবির খবর নেই। তারপর ভালো ছবির সংখা নগণ্য। সর্বশেষ কুরবানী ঈদে তিনটি ছবি পেয়েছি। তারপর থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো ছবি পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো আর্ট ফিল্ম।
ব্যবসার প্রশ্নে আর্টফিল্ম গলার কাঁটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর্টফিল্ম সিনেপ্লেক্সে দর্শক টানে না। ফলে বাধ্য হয়ে পুরনো ছবি বারবার চালাতে হচ্ছে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার চেয়ে পরিকল্পনা করছি, হলটি বন্ধ করে দেওয়ার।
তিনি বলেন, সিনেমা হল বাঁচাতে গেলে বেশি বেশি ভালো সিনেমা বানাতে হবে। আগে প্রতি সপ্তাহে দুটি ছবি পেতাম। এখন মাসেও পাই না। মাসে দুটি করে ভালো ছবি পেলেও হল চালিয়ে নেওয়া যায়। দেশে ছবি বানাতে না পারলে আমদানির সুযোগ দিতে হবে। আমরা তো ভারত থেকে ছবি আমদানি করে চালাচ্ছিলাম। টিকে ছিলাম। সে রাস্তাও বন্ধ করে দিল।
তিনি জানান, মণিহারে দর্শক আসন সংখ্যা ১ হাজার ৪৩০টি। বছরের দুয়েকবার বাদে অধিকাংশ সময় আসনগুলো শূন্য পড়ে থাকে। প্রতি মাসে বিদ্যুৎবিল আসে প্রায় দেড় লাখ টাকা। ২৫ জন কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ বিল, সিনেমা কেনার টাকাসহ ব্যবস্থাপনা খরচ এ খাত থেকে উঠে না। হলের সাথে থাকা আবাসিক হোটেলসহ অন্যান্য স্থাপনা থেকে উপার্জিত অর্থে মেটানো হয় হলের লোকসান। এমন পরিস্থিতিতে হলটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে এটা ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। ভবিষ্যতে কোনো বিকল্প উদ্যোগ নিলেও মূল স্থাপনা ঠিক রাখাসহ চালু থাকবে ‘মণিহার সিনেপ্লেক্স’। প্রয়োজনে সেটির সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে।
উল্লেখ্য, ৯০ দশকের শেষভাগ পর্যন্ত দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩০০টির ওপরে। এখন কমতে কমতে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০-৭৫টিতে। এর মধ্যে সবগুলো চালু নেই। নতুন করে বন্ধ হতে যাচ্ছে মণিহার সিনেমা হল। লোকসানের কারণে এর আগেও বেশ কয়েকবার বন্ধ হয়েছিল দেশের সর্ববৃত্তম এই সিনেমা হলটি।
মণিহার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ বলেন, আগে সিঙ্গেল স্ক্রিন ছিল, সবাই বলত ভালো পরিবেশ দিলে দর্শক হলে আসবে। এরপর মাল্টিপ্লেক্স করা হয়। যদি সিনেমা না থাকে, ভালো পরিবেশ দিয়ে কী হবে। মাসে অন্তত একটা ভালো ছবি থাকলেও টিকে থাকা যায়। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, শুধু মনিহার নয়, সব হল মালিকই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
তিনি আরও বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মালিকপক্ষ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। সাফটা চুক্তির আওতায় সিনেমা আমদানি না করতে পারলে হল টিকবে না।
মণিহার সিনেমা হল ১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। হলটির নকশা করেছিলেন কাজী মোহাম্মদ হানিফ। হলের সাজসজ্জার কাজ সম্পন্ন করা হয় কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের তত্ত্বাবধানে। শুরুতে এই সিনেমা হলে সারাবছর লেগে থাকত সিনেমাপ্রেমীদের ভিড়। হলটি দেখতে দলে দলে দর্শক আসত দেশের সকল প্রান্ত থেকে।