ঋণের বোঝা অসহনীয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে: সংসদে জি এম কাদের

জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে উচ্চাভিলাষী অভিহিত করে এর প্রভাবে ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংসদের উপনেতা ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

তিনি বলেছেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি তেলসহ অধিকাংশ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মতো চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক উচ্চ প্রত্যাশা রাখা হয়েছে। তাই এই বাজেট উচ্চাভিলাষী। প্রায় পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার (৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা) প্রস্তাবিত এই বাজেট এক কথায় গতানুগতিক। আগের বছরগুলোর মতো সব খাতকে একটি নির্দিষ্ট হারে বাড়ানো হয়েছে। এই বাজেটের ফলে ঋণের বোঝা অসহনীয় হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জি এম কাদের এসব কথা বলেন।

এ সময় ঘাটতি বাজেটের সমালোচনা করেন তিনি। বাজেটে বর্ধিত কর আদায়ের প্রস্তাবকেও অবাস্তব বলে উল্লেখ করেন। প্রস্তাবিত এই বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি) বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করছেন জি এম কাদের।

তিনি বলেন, এই বাজেট ঘাটতির বাজেট, ঋণনির্ভর বাজেট। বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ ঘাটতি পূরণ করতে ঋণ নেওয়া হবে মোট ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৩৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর বাইরে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ২১ দশমিক ৬ শতাংশ।

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান আরও বলেন, বাজেটে প্রস্তাবিত আয় সম্পূর্ণভাবে খরচ হবে পরিচালন ব্যয় ও আগের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেট প্রস্তাবিত প্রাপ্তি ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা সরকারের আয়। পরিচলন ব্যয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের এককভাবে বড় একটি অংশ সুদ হিসেবে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ঋণের ওপর পরিশোধ করতে হবে। সামনের বছরগুলোতে এটি বাড়তে থাকবে।

তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে ও নানাবিধ কারণে বর্ধিত কর আদায় প্রয়োজন হবে। তবে বর্ধিত কর আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত মনে হয় না। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা (মূল বাজেটেও একই অঙ্ক ছিল)। বাস্তবে মে ২০২২ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯১০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। একই হারে রাজস্ব আদায় অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে মোট রাজস্ব আদায় হবে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯০২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এরপরও ঘাটতি থাকবে ৫৪ হাজার ৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সেখানে আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অবাস্তব বলে মনে করি।

এডিপি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জি এম কাদের বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটেও উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। আগামী প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপির আকার বাড়িয়ে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এডিপি বাস্তবায়নও সম্ভব হবে না।
বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা দেশীয় ব্যবসায়ীদের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন জি এম কাদের।

তিনি বলেন, দেশি খাত থেকে সরকারের বেশি ঋণ ক্ষুদ্র ব্যবসা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিদেশি ঋণের ঝুঁকি আরও মারাত্মক। কেননা অর্থমন্ত্রীর কথায় বোঝা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ দিন দিন কমছে। আমদানি বাড়ছে, রফতানি আয় তেমন বাড়ছে না। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠান অর্থের (রেমিট্যান্স) পরিমাণও দেখা যাচ্ছে নিম্নগামী। সে প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আরও সাবধানতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

বাজেটে প্রস্তাবিত মূল্যস্ফীতির হিসাবও অবাস্তব দাবি করে জি এম কাদের বলেন, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় বলেছেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। একইসঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাব বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচাতে আগামীতে সরকারকে কর লাঘবসহ ভর্তুকি দিতে হবে। ফলে সরকারের প্রাপ্তি কমবে, খরচ বাড়বে সার্বিক ঘাটতি আরও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেট কমাতে হবে। প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে প্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ বাস্তবসম্মত নয়।

বর্তমান ঋণের পরিস্থিতি কী, সেটি বিশ্লেষণ করে জি এম কাদের বলেন, আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ (২০২২) পর্যন্ত ১৩ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ ৭৯ হাজার ১০৩ টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে জিডিপি দেখানো হয়েছে ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ছয়শ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এছাড়া দেশীয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বা জিডিপির হিসাবে ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ঋণের পরিমাণ প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এই বাজেটে ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রায়। প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির হিসাবে ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াল ১৬ লাখ ৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায়। ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ ৯২ হাজার ৬৬২ টাকা। এর মধ্যে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩৫ হাজার ২৯৪ টাকা, মাথাপিছু দেশি ঋণের পরিমাণ ৫৭ হাজার ৩৬৮ টাকা।

জি এম কাদের বলেন, আমরা অনেক সক্ষমতার অর্জনের জন্য গর্ব করি। আমাদের বড় বড় প্রকল্পগুলোতে কারিগরি কাজগুলো কি আমরা নিজস্ব বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী বা কারিগর দ্বারা সম্পন্ন করি? মনে হয় না। অর্থাৎ আমাদের কারিগরি সক্ষমতা তৈরি হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হয়? বর্তমানে প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেট সম্পূর্ণ অর্থায়ন প্রস্তাব ঋণের মাধ্যমে। অর্থাৎ অথনৈতিকভাবেও আমরা এখনো পরমুখাপেক্ষী। নিজস্ব অর্থে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জিত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা হবে আমাদের একটি চ্যালেঞ্জ।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ