টেলিভিশনে নাটকের কদর কমছে

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের দর্শকের ঘরোয়া বিনোদন মাধ্যম ছিল শুধু টিভি নাটক। একটি মাত্র চ্যানেলের (বিটিভি) মাধ্যমে তখন বিনোদনের চাহিদা পূরণ করা হতো। দীর্ঘ সময় এ চ্যানেলটি দর্শকের বিনোদন চাহিদা পূরণ করে এসেছে। কিন্তু একুশ শতকের শুরুতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হলে নাটক নির্মাণের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে দর্শকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আগে বিটিভিতে সাপ্তাহিক নাটক প্রচার হলেও পরে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদিন নাটক প্রচার করতে শুরু করে। নিত্য নতুন গল্প, নির্মাণে বৈচিত্র্য এবং দক্ষ অভিনয়শিল্পীর সমন্বয়ে নাটকগুলো নির্মিত হতে থাকে। এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই টিভি নাটকের প্রসার লাভ করতে থাকে। এর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই অভিনয়শিল্পীর পেশায় নাম লেখান। বাড়তে থাকে নাটকের জৌলুশ।

সাম্প্রতিক সময় সেই গৌরব হারাতে বসেছে টিভি নাটক। এর জন্য প্রায় সব পক্ষই দায়ী। বাজেট স্বল্পতা, গল্পের দুর্বলতা, আনকোরা অভিনয়শিল্পী নিয়ে কাজ করা এবং লাগামহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে দর্শক টিভিতে প্রচারিত নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। এসব দর্শক বিকল্প বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে অনলাইনকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ, অনলাইনেই সুবিধাজনক সময়ে নাটক দেখে নিতে পারছেন তারা। টিভিতে নির্দিষ্ট সময় প্রচারের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না তাদের। ফলে একঝাঁক তরুণ নির্মাতার পাশাপাশি কিছু নামি নির্মাতাও অনলাইনের দিকে ঝুঁকেছেন। এতে করে টিভিতে প্রচারিত নাটকের প্রতি মানুষের আগ্রহ একেবারেই কমে গেছে। এ মাধ্যমে প্রচারিত নাটকও হয়ে পড়ছে বৈচিত্র্যহীন। শুধু উৎসবকেন্দ্রিক সময়গুলোতে কিছুটা বৈচিত্র্য কিংবা দর্শকের পছন্দের কথা মাথায় রেখে নাটক প্রচারের চেষ্টা করে টিভি চ্যানেলগুলো।

দর্শক হারালেও এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কিংবা নির্মাতারা। অন্যদিকে কথিত আছে টিভির নাটকগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন কিছু এজেন্সির কাছে। তারাই গল্প এবং অভিনয়শিল্পী ঠিক করে দিচ্ছেন। এতে করে মানের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। অনেকেই বলেন, বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যই এখন নাটক প্রচার করা হয়। এ নিয়ে দর্শক থেকে শুরু করে প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পীরাও বিব্রত। প্রথম সারির অভিনয়শিল্পীরাও টিভি নাটক নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নাট্যাভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনলাইনে নাটক প্রচারের কারণে কিছু দর্শক টিভি থেকে হয়তো সরে গেছে। এটা স্বাভাবিক বিষয়ই মনে হয় আমার কাছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। তবে টিভি নাটককে যেন আরও সময়োপযোগী করা যায়, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার কাজ করা উচিত। তরুণ দর্শকের সঙ্গে এখন বয়স্করাও কিন্তু অনলাইনে ঝুঁকেছেন। টিভিতে নাটক প্রচারকালীন বিজ্ঞাপন প্রচার সীমিত করতে হবে। টিভি নাটকের এ সময়ে এসে আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে এটার গ্রহণযোগ্যতা আরও নিুমুখী হয়ে যেতে পারে।’

জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ মাধ্যমে কাজ করা লোকদের আন্তরিকতা নাই। টিভি চ্যানেলগুলো দর্শকদের প্রতি আন্তরিক না হয়ে যদি বিরতিহীন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে এবং অভিনয়শিল্পীদেরও যদি কাজের প্রতি দরদ না থাকে, যারা নির্মাতা তাদের যদি দায়বদ্ধতা না থাকে তাহলে এমন অবস্থা তো হবেই। বিষয়টি নিয়ে সবারই সতর্ক হওয়া উচিত।’

‘ইদানীং টিভি নাটকের দর্শক কমে যাওয়াটা বেশ নেতিবাচক বিষয়। এর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোরও দায় রয়েছে। কারণ টিভিতে নাটক প্রচারের সময় মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার হয়। তবে ইউটিউব কিংবা ওটিটিতে এ রকম কোনো বিড়ম্বনা নেই। দর্শক তার সময়মতো নাটক দেখে নিতে পারছেন। আর নির্মাতারা টিভির চেয়ে ইউটিউব থেকে বেশি আয় করতে পারছেন। তাই অনেক মেধাবী নির্মাতা এখন আর টিভিতে নাটক প্রচারের বিষয়ে আগ্রহী নন।’

– মামুনুর রশিদ, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব

‘টিভি নাটকের দর্শক কমছে, এটি খুবই উদ্বেগের একটি বিষয়। এখন অনেক টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে এসেছে। প্রচুর নাটকও তৈরি হচ্ছে। তবে কেন জানি টিভি থেকে দর্শক ইউটিউব, ওটিটিসহ অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে ঝুঁকছেন। টিভি নাটকের মূল দর্শক হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাদের টার্গেট করে এখানে নাটক নির্মাণ করতে হবে। তা ছাড়া টিভিতে দর্শক ধরে রাখার জন্য দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটকের প্রচার বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই দর্শক টিভিতে স্থির হবেন।’

– তারিক আনাম খান, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ