বিশ্ববাজারে গমের দরপতন, দেশে বেড়েছে আটার দাম

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে রেকর্ড হয় গমের দামে। এর আঁচ পড়ে বাংলাদেশেও। স্থানীয় বাজারে রেকর্ড গড়ে আটার দর। কিন্তু বিশ্ববাজারে গমের দাম তিন বছর ধরে টানা কমলেও দেশে সে হারে কমেনি আটার দাম। ফলে অতিরিক্ত দাম দিয়েই ভোক্তাকে আটা কিনতে হচ্ছে। প্যাকেট আটার দর এখন মোটা চালের চেয়েও বেশি। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে তাদের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি দেশে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে।
ফলে তারা বিশ্ববাজারের মতো দাম কমাতে পারছেন না।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে। কিন্তু আমদানিকারকরা সেই অনুযায়ী দেশে দাম সমন্বয় করেননি। কী দরে গম আমদানি হচ্ছে, কত টাকা শুল্ককর দিতে হয়– এসব বিষয় বিবেচনা নিয়ে দর নির্ধারণ করা উচিত। অতি মুনাফার চেষ্টা হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অন্যথায় ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১৬ মে বিশ্ববাজারে প্রতি টন গমের দাম সর্বোচ্চ ৪৫৭ ডলার স্পর্শ করে। এর পর একই বছরের ২৪ অক্টোবর প্রতি টনের দাম কমে ৩৩৫ ডলারে নামে। চলতি বছরের ২০ অক্টোবর প্রতি টনের দর কমে হয় ২১৮ ডলার। সে হিসাবে তিন বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে দর কমে প্রায় অর্ধেক হয়েছে।

বিশ্ববাজারে গমের দর পতন হলেও দেশে তার প্রভাব পড়েনি। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর দেশে প্রতি কেজি খোলা আটার দর ৫৫ থেকে ৫৮ এবং প্যাকেট আটার দর ৫৮ থেকে ৬০ টাকা ছিল। গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা ৪৫ থেকে ৫২ এবং প্যাকেট আটার দর ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সে হিসাবে তিন বছরে খোলা আটার দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা কমলেও প্যাকেট আটার দাম উল্টো ৫ টাকার মতো বেড়েছে।
সাধারণত খোলা আটার চেয়ে দুই কেজি ওজনের প্যাকেট বেশি বেচাকেনা হয়। কয়েক মাস আগেও কোম্পানিগুলোর দুই কেজির প্যাকেটের গায়ের দাম ছিল ১১০ বা ১১৫ টাকা। এখন দর লেখা আছে ১৩০ টাকা। পাড়া-
মহল্লার মুদি দোকানদাররা সাধারণত গায়ের দরেই বিক্রি করে থাকেন। প্যাকেট আটার দর এখন মোটা বা গুটি স্বর্ণা চালের দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা।

ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে, বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বাড়ার কারণে তাদের খরচ বেড়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে ডলারের দাম ছিল ১০৬ টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম প্রায় ১২২ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি ডলারের দর বেড়েছে ১৬ টাকা। এ ক্ষেত্রে তাদের গমের আমদানি খরচও বেড়েছে।

তবে হিসাব করে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে ২০২২ সালে অক্টোবরে প্রতি টন গমের দর ৩৩৫ ডলার ধরলে স্থানীয় মুদ্রায় (এক ডলার সমান ১০৬ টাকা) দর হয় ৩৫ হাজার ৫১০ টাকা। বর্তমানে প্রতি টনের দর ২১৮ ডলার ধরলে স্থানীয় মুদ্রায় মোট দাম পড়ে (এক ডলার সমান ১২২ টাকা ধরে) ২৬ হাজার ৫৯৬ টাকা। অর্থাৎ ডলারের দাম বাড়ার পরও বিশ্ববাজার থেকে তিন বছর আগের তুলনায় এখন প্রতি টন গম প্রায় ৯ হাজার টাকা কমে আমদানি করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে গমের চাহিদা রয়েছে ৭০ লাখ টন। যদিও আমদানিকারকদের মতে, চাহিদা ৮০ লাখ টনের মতো। দেশে বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টন গম উৎপাদন হয়। ফলে চাহিদার সিংহভাগ গম আমদানি করতে হয়। গম আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে মোট ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১১ লাখ টনের বেশি।

জানতে চাইলে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান রেদওয়ানুর রহমান সমকালকে বলেন, এখনকার তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে গমের দাম প্রায় ৫৭ শতাংশ বেশি ছিল। তখন আমদানিকারকরা খুব বেশি আমদানি করেনি। ২০২২ সালের তুলনায় বর্তমানে ডলারের দাম ৭০ শতাংশের মতো বেশি। এ ছাড়া এক-দেড় বছর ধরে শীর্ষ আমদানিকারকদের কেউ কেউ নানা কারণে আমদানি বন্ধ রাখছে। কেউ সীমিত আকারে আমদানি করে কোনোমতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখছে। ফলে আগের তুলনায় বাজারে আটার সরবরাহ কম। কিন্তু দেশের যে চাহিদা তা কমেনি। বরং দিন দিন বাড়ছে। ফলে স্থানীয় বাজারে দাম কমার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী সমকালকে বলেন, গমের দাম নির্ধারিত হয় মূলত প্রোটিনের পরিমাণ দেখে। প্রোটিন বেশি থাকা মানে গম ভালো। আর ভালো গমের দাম বেশি হয়।
গমের টন যদি ২২০ বা ২২২ ডলার হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেটি এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) মূল্য। এর সঙ্গে অন্তত ৫০ ডলার জাহাজ ভাড়া যুক্ত হবে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে গমের দাম বেড়েছিল, তখন ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে আটা-ময়দার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়াল। এখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে। তবে ব্যবসায়ীরা সে অনুযায়ী দেশে দাম সমন্বয় করেনি।

তিনি বলেন, ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়ার পর দেশে আটা-ময়দায় তৈরি বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো পণ্যে আবার দাম না বাড়িয়ে পরিমাণ কমানো হয়েছে। এখনও সেভাবেই বেচাকেনা হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ঠকছেন ভোক্তা। সরকারের দুর্বল তদারকির কারণে গুটিকয়েক কোম্পানি ভোক্তাকে জিম্মি করে রাখছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র‍্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, আমদাকিারকরা কত দরে কখন আমদানি করেছিলেন, কত টাকা শুল্ককর দিতে হয়েছে– এসব বিষয় বিবেচনা নিয়ে দর কত হওয়া উচিত তা খতিয়ে দেখা উচিত ট্যারিফ কমিশনের। আটা অত্যাবশ্যক পণ্য। এর আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজার বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, কেউ অতি মুনাফা করছে কিনা। ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফারুক আহম্মেদ বলেন, গমের আমদানি মূল্য, শুল্কহার ও স্থানীয় বাজারে দাম কত হওয়া উচিত, তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখভাল করে। ভোক্তা অধিদপ্তরের আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আইন অনুযায়ী যতটা সম্ভব জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার তদারকি করা হয়। তার পরও আটার দামের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ