দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে হয়ে গেল এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনোমিক কোঅপারেশনের (এপেক) শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে, তাতে বিশ্ব কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পেয়েছে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শক্তির মধ্যে পরিববর্তশীল পরিস্থিতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধে মূলত কোন নেতা জিতে গেলেন, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে আলোচনা উঠেছে। তবে দুই নেতার ক্ষমতার ভারসাম্যে যে পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে তাদের কোনো মতবিরোধ নেই।
বুসানে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে চীনা নেতা দর কষাকষিতে অগ্রগামী ছিলেন। ২০০৯ সালে তাদের মধ্যে শেষ বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে নিজের অগ্রাধিকার বুঝে নিলেনও শি প্রযুক্তি সম্পর্কিত রপ্তানিতে বিরল ছাড় দিয়ে ট্রাম্পকে খুশি করেছেন।
চীনা নেতা নিজেই দুজনের মধ্যে সমান মর্যাদার বিষয়টিতে জোর দেন এবং এক জাহাজের দুই অধিনায়কের ভাবমূর্তি নির্মাণ করেন। তিনি বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বিশাল জাহাজের অবিচল যাত্রা নিশ্চিত করা উচিত।
আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের অনাবাসী সিনিয়র ফেলো ডেক্সটার রবার্টস আল জাজিরাকে বলেন, চীন বিশ্বাস করে, দুই পক্ষ এখন অনেক বেশি কাছাকাছি। নতুন সমঝোতার মাধ্যমে চীন অবশ্যই নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তার মর্যাদা খানিকটা নিচে নামিয়েছে।
বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চংইয়াং ইনস্টিটিউট ফর ফাইন্যান্সিয়াল স্টাডিজের ডিন ওয়াং ওয়েন বলেন, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পর থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতা পরিবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ এক প্রকার ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। চীনের শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে শিখতে বাধ্য করেছে। তিনি মনে করেন, দুই দেশ সত্যিই সমতার যুগে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চীনকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করবে- এখন সেই যুগ শেষ হয়ে গেছে।
২০১৮ সালে ট্রাম্প চীনের সঙ্গে তার প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার পর থেকে বেইজিং মার্কিন চাপকে আরও ভালভাবে মোকাবিলা করতে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। দেশটি ওয়াশিংটনের ওপর নিজস্ব চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে।
এর প্রমাণ মেলে গত মাসে। রপ্তানির ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন হাজার হাজার চীনা সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর বেইজিং ঘোষণা করে, বিশ্বের যেকোনো কোম্পানিকে চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি করতে বেইজিংয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। এই পদক্ষেপটি বেইজিংয়ের স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। কারণ বিরল খনিজ এমন পদার্থ- যা স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। চীন এই খনিজের ৭০ শতাংশ উৎপাদন করে এবং ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ চীনেই হয়।
বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক উপদেষ্টা সংস্থা টেনেওর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল ওয়াইল্ডাউ বলেন, বিরল খনিজের ওপর চীন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য পরিবর্তনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে চীনা রপ্তানিকারকদের
ব্লুমবার্গ জানায়, চীনা রপ্তানিকারকরা অনেকটা নিশ্চিত যে, বাণিজ্যযুদ্ধে চীনকে আর থামাতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র। দুই নেতার মধ্যে শীর্ষ সম্মেলনের পর মার্কিন শুল্ক কমেছে। এতে চীনা রপ্তানিকারকরা খুশি, তবে তারা ভবিষ্যতে যেকোনো ঝুঁকি এড়াতেও প্রস্তুত আছে।
তাছাড়া মার্কিন খুচরা বিক্রেতারা চীন থেকে সরবরাহ শৃঙ্খল সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করবে- এটার সম্ভাবনা কম এবং চীনা ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বাজারে রপ্তানি সম্প্রসারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গুয়াংজু-ভিত্তিক খুচরা বিক্রেতারা মনে করেন, মার্কিন শুল্ক হ্রাসের ঘটনা তাদের স্বস্তি দেবে। যদিও তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। শুল্ক আরোপের আগে বার্ষিক বিক্রির ৮০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতার দখলে ছিল। দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্য ঝুঁকি হ্রাস করতে নির্ভরতা কমিয়ে আনাই একমাত্র উপায় বলে তারা মনে করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় শি’র সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ফেন্টানাইলের ওপর আরোপিত শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের মতে, ট্রাম্পের ও ঘোষণার ফলে চীনা পণ্যের ওপর গড় হার ৩১ শতাংশে নেমে আসবে। ফলে ব্রাজিল বা ভারতের তুলনায় চীন বেশি সুবিধা পাবে। চীনের রপ্তানিকারকদের আশা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতির ফলে চীনা অর্থনীতির ক্রমপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
পূর্ব চীনের রপ্তানি ঘাঁটি নিংবো থেকে মোপসের মতো গৃহস্থালী পরিষ্কারের পণ্য বিক্রি করে এমন একটি সংস্থার বিক্রয় ব্যবস্থাপক আন্দ্রে হুয়াং। তিনি বলেন, এখন আমরা মার্কিন গ্রাহকদের সঙ্গে আরও ভাল চুক্তি করতে সক্ষম হবো।
ব্লুমবার্গ বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও ব্যবসার সম্ভাবনার বিষয়টি এখন আর চীনা রপ্তানিকারকদের আগের মতো উত্তেজিত করে না। চীন ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ট্রাম্পের বাণিজ্য-কৃপণতা থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছেন। এখন তারা বুঝতে পেরেছেন, এখন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। কারণ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বাজারগুলোতে চীনের পণ্যের চাপ স্পষ্ট।
ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য অংশে মার্কিন পণ্য রপ্তানি হ্রাসের কারণে এই বছর চীন রেকর্ড ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পথে রয়েছে। সাংহাই-ভিত্তিক মালবাহী ফরওয়ার্ডার কেভেন চেন বলেন, চীনা নির্মাতারা কেবল মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভর করতে পারে না।
নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বিরল খনিজের ওপর চীনের প্রায় একচেটিয়া অধিকার এবং মার্কিন সয়াবিনের ওপর ক্রয় ক্ষমতাকে তুলে ধরে শি ওয়াশিংটনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছাড় জিতেছেন। হোয়াইট হাউস ও পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ জুলিয়ান গেউইর্টজ গণমাধ্যমটিকে বলেন, স্পষ্টতই চীন সুবিধা গ্রহণে ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠেছে।
নানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝু ফেং মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর নতুন কোনো ব্যবস্থা আরোপ করার আগে এখন দুবার ভাববে। এটাই চীনের জন্য সবচেয়ে বড় জয়।
সূত্র: নিউইয়র্ক টামইস, ব্লুমবাগ ও আল জাজিরা