পর্যটনে সম্ভাবনা প্রচুর, শুধু উদ্যোগ নেই

আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান খুব বেশি নয়। এ ক্ষেত্রে প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও আজ পর্যন্ত এর সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। আর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা এবং কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও সে ক্ষেত্রেও কচ্ছপ গতির কারণেই পর্যটন খাত এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপালসহ পৃথিবীর অনেক ধনী রাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও পর্যটন খাতের আয়-রোজগার ঈর্ষণীয়! সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের আমাদের দেশের মতো বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সি-বিচ ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও সেসব দেশ পর্যটকে ঠাসা। মহামারি করোনার ধকল কাটিয়ে এসব দেশ পর্যটকদের আকর্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বর্তমানে পর্যটনকারী মানুষের আনাগোনায় সেসব দেশ মুখর হয়ে উঠেছে।

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে কিছু কাজ সেরে হাতে থাকা বাকি দুদিন সময় কাটাতে আমি লঙ্কাউয়ি দ্বীপে এসে সেখানে এলাহি কারবার দেখতে পেলাম। পুরো দ্বীপটিতে পর্যটকের ভিড়। আর কোন্ দেশের মানুষ আসেনি সেখানে! অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে শুরু করে ইংল্যান্ড থেকেও এখানে পর্যটক এসেছেন। এখানকার পানতাই (Pantai) সি-বিচে গিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। পিৎজা অর্ডার করতে গিয়ে লম্বা কিউ দেখে সেখান থেকে বের হয়ে সি-বিচে গিয়ে খানিকক্ষণ বসলাম। সেখানে লোকাল শিল্পীরা গানবাজনা করে আমাদের আনন্দ দান করলেন। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শুরু হলো আগুন খেলা।

জ্বলন্ত আগুনের রিং বা রড হাতে নিয়ে চড়কির মতো ঘুরানো, আগুনে তীর উপরে ছুড়ে তা আবার হাত দিয়ে ধরা, বৃহৎ আকারের অগ্নি গোলক উপরে পাঠিয়ে চমক সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে পর্যটকদের আনন্দ দান করায় আমরা মুগ্ধ হয়ে তা দেখতে থাকলাম। আর এসবই বিনা পয়সায় স্থানীয় বাসিন্দা বা তাদের সংগঠনের মাধ্যমে করা হলো। অতঃপর রাত প্রায় ১০টার দিকে একজন সিকিউরিটি গার্ড একটি ট্যাক্সি ডেকে দিলে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, পাঁচ কিলোমিটার পথ পার হয়ে হোটেলে পৌঁছালে ট্যাক্সিওয়ালা মাত্র সাড়ে পাঁচ রিঙ্গিত (১১৫) টাকা দাবি করলেন!

উপরের ঘটনাটি প্রমাণ করে পর্যটন ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি কেন? পর্যটক পেলেই ট্যাক্সিওয়ালা কয়েকগুণ বেশি ভাড়া চাইবেন বা আদায় করবেন, দেশি-বিদেশি পর্যটককে এদিক সেদিক টেনে নিয়ে যাবেন, সে ক্ষেত্রে বিদেশি কেন, দেশি পর্যটকরাও তো ভয় পেয়ে তাদের অনেকে সেদিকে পা বাড়াবেন না।

তারাও তো নিরাপদ পর্যটন ক্ষেত্রের সন্ধান করবেন; হোক তা বিদেশে। তাছাড়া পর্যটনের আনুষঙ্গিক অন্যান্য সুবিধাও আমাদের দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে নেই বললেই চলে। যেমন আমাদের হোটেলের সামনের বিচের বিচ চেয়ারে দু’জন যুবক-যুবতীকে যেভাবে শায়িত দেখলাম তেমনটি কক্সবাজারে দেখা গেলে সেখানে যে শত শত মানুষের ভিড় জমে যেত, সে কথা বলাই বাহুল্য। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও আমাদের মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। একজন বিদেশি-বিদেশিনীকে দেখে ভিড় করা বা স্বল্পবসনার এমন কাউকে দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

কারণ বিদেশিরাও এসব বোঝেন বিধায় তাদের ওঠাবসা চালচলনকে সহজভাবে গ্রহণ না করে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখলে তারাও আমাদের এড়িয়ে চলবেন। ভারতের গোয়া সি-বিচেও আমি বিদেশি নারী-পুরুষকে এমনভাবে শায়িত অবস্থায় দেখেছি যা বলার মতো নয়। অথচ সেখানকার যুবকসহ অন্যদের নির্বিকারভাবে সেসব দৃশ্য পাশ কাটিয়ে যেতে দেখেছি। আর থাইল্যান্ডের পাতাইয়া, ফুকেটসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তো এসব দৃশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা হয়।

যদিও ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেশে এসব দৃশ্যকে বেলাল্লাপনা বলাই স্বাভাবিক, তবে এ ক্ষেত্রে যার যার ধর্ম এবং সামাজিক আচার তার তার নীতি গ্রহণই সমীচীন হবে বলে মনে করি। কারণ আরব বিশ্বের সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই নীতিতে তাদের পর্যটন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

দুবাই সি-বিচে আমি যা দেখে এসেছি সে কথাটি এখানে নাইবা উল্লেখ করলাম। তা ছাড়া সৌদি আরবও পর্যটন শিল্প বিকাশের স্বার্থে সারা দেশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে; ওমরাহ পালনকারী যে কোনো ব্যক্তি এখন মক্কা-মদিনা ছাড়াও সারা সৌদি আরব ঘুরে বেড়াতে পারবেন।

আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের আরও একটি বড় অন্তরায় হলো আমলানির্ভরতা। আমলাদের হাতে এ শিল্প খাত ছেড়ে দেওয়ায় পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ইত্যাদি সংস্থা যাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় বা হয়েছে তাদের একজন যান আর একজন আসেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় বলে মনে হয় না।

বরং একজন অতিরিক্ত সচিব এসব চেয়ারে বসেই সচিব হওয়ার ধান্ধায় চেয়ারটি ব্যবহার করে সময় কাটিয়ে যান মাত্র। আর এ সময়টুকুও তারা উপরস্থদের মনতুষ্টিতেই ব্যস্ত থাকেন। কে কখন বা কার পরিবারের কে কখন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেড়াতে যাবেন সেসব দেখভালের বিষয়েই তারা বেশি মনোযোগী থাকেন! এ অবস্থায়, পর্যটন খাতের উন্নয়নের স্বার্থে উপরোক্ত দুটি সংস্থার প্রধান হিসাবে তুখোড় কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই উপযুক্ত বলে মনে করি। কারণ সে ক্ষেত্রে তিনি উপরের কাউকে সন্তুষ্ট করে পদোন্নতি বাগাতে চাইবেন না; দিনরাত স্যার, স্যার বলে মুখে ফেনাও তুলবেন না।

কথাটি এভাবে বলার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু কী করব, বর্তমান অবস্থায় যাদের হাতে পর্যটন খাত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তারা তেমন কোনো উন্নতি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন! আজ এখনো সবই হবে হচ্ছের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওপেন চেক দিয়ে রাখলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাও এখানে তুলে ধরতে চাই। আমার কর্মজীবনের বয়স ৪৬ বছর পার হতে চলল। গত ১০ বছর আগ পর্যন্ত যে আয়-রোজগার হয়েছিল তা একত্র করে বিনিয়োগ করায় সেই আয় রোজগারের আয়করের ওপর অতিরিক্ত সারচার্জসহ আমি আয়কর প্রদান করে থাকি।

এ অবস্থায় কক্সবাজারে ছোট একটা রিসোর্ট করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, দূষিত ঢাকা নগরীতে না থেকে, বাকি জীবন কক্সবাজারে কাটিয়ে দেব; আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরব। তো একদিন এ অভিপ্রায়টি ট্যুরিস্ট ডেভেলপমেন্ট সংস্থার কর্ণধারের কাছে ব্যক্ত করায় সহযোগিতার জন্য তিনি তার দপ্তরে যেতে বললে, আমি যথারীতি সেখানে গিয়ে হোঁচট খেয়ে ফিরে এলাম। তিনি বললেন, এসব বিষয় তার আওতায় পড়ে না, পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান এসব দেখভাল করেন।

সেই সঙ্গে তিনি এ কথাটিও যোগ করলেন, সাংবাদিক এসেছেন, তিনি এখন সাক্ষাৎকার দেবেন। আমিও দেখলাম, ক্যামেরাসহ সাংবাদিক রেডি হয়ে বসে আছেন। তবে আসার সময় সেদিন তাকে এ কথাটি বলে আসতে পারি নাই যে, ‘তাহলে আমাকে আসতে বলেছিলেন কেন?’ কারণ কথাটি বলতে আমার রুচিতে বেঁধেছিল। সেদিন পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের দপ্তরে গিয়েও দেখি, সে সময় পর্যন্ত তিনি অফিসে আসেননি!

পরিশেষে পর্যটন ক্ষেত্রের তুলনামূলক একটি আলোচনা করেই আজকের লেখাটি শেষ করব। এখানে আমি নেপালের পোখরার ‘ফেওয়া’ লেক এবং কাশ্মীরের শ্রীনগরের ‘ডাল’ লেক এ দুটি লেক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। কারণ দুটি লেকই আমি দেখেছি এবং বোটে করে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছি।

পোখরার ফেওয়া লেক একটি অত্যন্ত সাদামাটা এবং বলা চলে নিুমানের একটি ভ্রমণ স্থল। মানুষজন পোখরা যান এবং সেখানে দড়ির ঝুলন্ত সেতুসহ পাহাড়ের তলদেশের নদী ইত্যাদি দুই-এক স্থান ভ্রমণ শেষে আর কিছু দেখার না থাকায় একবেলা ফেওয়া লেক ভ্রমণ করেন।

কাশ্মীরের ডাল লেক ফেওয়া লেক অপেক্ষা কিছুটা উন্নত। কারণ লেকটির এক পাশে রাস্তা, এক পাশে বোটহাউজ দিয়ে সাজানো আর এক দিকে পাহাড়ের অবস্থান। তবে সাজানো বোটহাউজের অংশ বাদ দিলে ডাল লেকও অনেকটা ফেওয়া লেকের পর্যায়ে নেমে আসবে। অন্যথায় শুধু কাশ্মীরের সৌন্দর্যের প্রচার-প্রচারণা এবং বোটহাউজের ক্যারিশমাই ডাল লেকের খ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ভালোভাবে যারা লেক দুটি দেখেছেন, আমার সঙ্গে তারা একমত হবেন বলেই মনে করি।

এবার আমাদের দেশের কাপ্তাই লেক প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ফেওয়া লেক, ডাল লেক, দার্জিলিং-এর গঙ্গা-মাইয়া ইত্যাদিসহ পৃথিবীর প্রচুর লেক আমি দেখেছি। কারণ সারা বিশ্বের ৫০টি দেশ আমি ভ্রমণ করেছি। এ অবস্থায় আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ, জেনেভাসহ সে দেশের অন্য দু-একটি স্থানে ভ্রমণ করে সেখানকার দু-একটি লেকের চেয়ে কাপ্তাই লেক আমার কাছে সুন্দর বলে মনে হয়েছে।

যদিও সেসব লেক সুইজারল্যান্ডের নামের ওপর দিয়ে পার পেয়ে যায়। আমাদের কাপ্তাই লেকের টিলা ও স্বচ্ছ সুন্দর পানি পৃথিবীতে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। কখনো সখনো কাপ্তাই গেলে সেখানকার লেকের দৃশ্য আমাকে পাগল করে তোলে! তাছাড়া সুন্দরবনের নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরবনের ভিতরের নদীতে মাঝরাতে নৌকা বা লঞ্চের ছাদে বসে জোছনার আলোর দৃশ্য, কক্সবাজারের সুন্দর লম্বা সমুদ্রতট এসব কিছুও আমাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু আমার দেশের এসব সৌন্দর্য দেখতে হলে যে ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, বর্তমান অবস্থায় নিতান্তই তা অপ্রতুল! আমলাদের হাতে তা বন্দি।

অন্যথায় কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের শত বছরের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিগত ৫০ বছর ধরে সরকারি আমলাদের হাতে কেন্দ্রটির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে রাখা হলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসে না কেন? এসব দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তারা কি জানেন যে, কক্সবাজারে একটি আধুনিক হাসপাতালসহ বড়সড় একটা শপিংমল নির্মাণ করা প্রয়োজন? আর সরকারি বিনিয়োগ ছাড়া তা সম্ভব নয়; বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেই তা সম্ভব। এ বিষয়ে কি কোনো সংস্থাপ্রধান সরকারকে লিখিত কোনো কিছু বলেছেন?

আমার মনে হয় না তাদের মাথায় এসব কিছু এসেছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা তো ইতোমধ্যেই কক্সবাজারকে কংক্রিটের বস্তি বানিয়ে ফেলেছেন। মুনাফাখোর ট্রাভেল এজেন্টরাও মানসম্মত সার্ভিস দিচ্ছেন না! একবার কক্সবাজার থেকে বান্দরবান ভ্রমণের টিকিট কাটার পর, ট্যুর অপারেটর মাইক্রোবাস করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমাদের মুড়ির টিনের মতো বাসে তুলে দিলে ভিতরের খারাপ অবস্থা দেখে আমরা স্বামী-স্ত্রী সে বাস থেকে নেমে এসেছিলাম।

আমার মতে, এসব দায়িত্বে যারা আছেন, তারা নিতান্তই সরকারি চাকুরে, তাদের দিয়ে পর্যটন শিল্পের সঠিক বিকাশ সম্ভব নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এককভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা শেষ হয়েছে। সুতরাং পর্যটন শিল্প বিকাশের স্বার্থে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। কারণ এ শিল্পও দেশের রাজস্ব আয় বাড়িয়ে রাজভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে, জিডিপিতে অবদান রাখতে পারে, মুদ্রা পাচার রোধ করতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ