নগরজীবনে বড় আতঙ্কের নাম ছিনতাইকারী

ঢাকা মহানগরীতে সক্রিয় ছিনতাইকারী হিসাবে সাড়ে পাঁচশ’র বেশি দুষ্কৃতকারীর নাম রয়েছে পুলিশের খাতায়। তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই আছে পুলিশের কাছে। কিন্তু পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে না অজ্ঞাত কারণে।

পুলিশের খাতায় নাম উঠলেও ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। ছিনতাইয়ের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। রহস্যটা কী? পুলিশ ছিনতাইকারীদের ধরার ব্যাপারে এত নির্লিপ্ত কেন?

গত ২৪ মে  বিষয়টি নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিস্ময়কর সব তথ্য রয়েছে, যা আমরা এতদিন জানতাম না।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। একেই বলে অনুসন্ধানী রিপোর্ট, যা খবরের পেছনের খবর তুলে আনে। পরদিন ২৫ মে একই পত্রিকায় এ সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম ‘ছিনতাইকারীরা অধরা’। এতে অপরাধীদের দমনে কার্যকর অভিযান চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন এবং সুচিন্তিত মন্তব্যসহ সম্পাদকীয় পাঠের পর আমিও এ বিষয়ে কিছু লেখার আগ্রহ সংবরণ করতে পারলাম না। কারণ আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। আমার সাংবাদিক জীবনে মোট ছয়বার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি। সবকটি ঘটনাই ঘটেছে মহানগরীর মতিঝিল রমনা এলাকায়।

সপ্তমবার যাতে ছিনতাইয়ের শিকার হতে না হয় সেজন্য যথেষ্ট সাবধান থাকি। ছিনতাইকারীরা শুধু টাকা-মোবাইল-গহনা ছিনিয়ে নেয় না, বাধা দিতে গেলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ভোরবেলা মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছিলেন।

এমন ঘটনা ঢাকা শহরে অনেক ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা কেউ বিশিষ্ট নাগরিক, কেউ সাধারণ মানুষ।

আমি প্রথমবার ছিনতাইয়ের শিকার হই ত্রিশ বছর আগে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে। সে সময় আমি ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলাম। ওই সময়ে কাজ শেষ করে পত্রিকার ধানমণ্ডি কার্যালয় থেকে রাত সাড়ে ১১টায় গোপীবাগে আমার বাসার উদ্দেশে যাত্রা করি অফিসের বেবিট্যাক্সিতে।

সঙ্গে ছিলেন আমার সহকর্মী স্টাফ রিপোর্টার মাসুদ হাসান খান। বেবিট্যাক্সিটি শাপলা চত্বর হয়ে ওয়াপদা ভবনের সামনে আসতেই একটি সাদা টয়োটা কার পেছন দিক থেকে এসে আমাদের গতিরোধ করে। গাড়ি থেকে প্যান্ট-শার্ট পরা দুই তরুণ দ্রুত নেমে এসে আমাদের বেবিট্যাক্সির দুই পাশে দাঁড়ায়। তাদের হাতে চকচক করছিল দুটি খোলা ড্যাগার।

তারা আমাদের মানিব্যাগ, হাতঘড়ি সব দিয়ে দিতে বলে। আমি আমার মানিব্যাগ হাতঘড়ি, দিয়ে দিলাম, মাসুদকেও বললাম দিয়ে দিতে। মাসুদের সঙ্গে একটি ক্যামেরা ছিল, সেটাও নিয়ে নিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে ছিনতাইকারী গাড়িতে উঠে চলে গেল। ওরা ছিল মোট চারজন।

পরদিন সকালে ডেইলি স্টার সম্পাদক এস এম আলীকে ঘটনাটি জানাই। তিনি তার পত্রিকায় ‘মাই ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি কলাম লিখতেন। কলামে তিনি আমাদের ছিনতাইয়ের ঘটনা বর্ণনা করে মন্তব্য করলেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ছিনতাইকারীরা ব্যবহার করেছে টয়োটা মোটর কার, আর সাংবাদিকদের বাহন ছিল বেবিট্যাক্সি!’

উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, সে সময়ে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে তিন চাকার যে অটোরিকশা চলাচল করত, সেগুলো বেবিট্যাক্সি নামেই পরিচিত ছিল। দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত এ অটোরিকশার দুই দিক খোলা থাকত। এতে ছিনতাইকারীদের সুবিধা হতো। পরবর্তীকালে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা তুলে দেওয়া হয় বায়ুদূষণের কারণে।

এর পরিবর্তে নামানো হয় সিএনজি-চালিত সবুজ অটোরিকশা। নতুন এই অটোরিকশারও দু’পাশ খোলা থাকত, ছিনতাইকারীরাও হামলা করত। যাত্রী ও চালকদের নিরাপত্তার জন্য পরে এই অটোরিকশায় লোহার রড দিয়ে বেড়া বা আচ্ছাদন দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ছিনতাইকারীর হামলার খবর শুনিনি। আমরা এখন খাঁচায় আবদ্ধ হয়ে সিএনজি অটোরিকশায় চলাচল করি।

১৯৯২ সালের প্রথম ছিনতাইয়ের পর আমি আরও পাঁচবার ছিনতাইয়ের শিকার হই এই রাজধানী শহরে। প্রতিবারই আমি একা রিকশার যাত্রী ছিলাম। সবকটি ঘটনাই ঘটে সন্ধ্যা অথবা রাতে। এরপর থেকে আমি কখনো সন্ধ্যা বা রাতে একা রিকশায় উঠি না। কেবল সন্ধ্যা বা রাতেই যে ছিনতাই হয়, তা কিন্তু নয়। দিনের বেলা কোনো নির্জন রাস্তায় কেউ যদি একা রিকশায় চলাচল করেন, তিনিও ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে পারেন।

রিকশাযাত্রীদের অভিনব কায়দায় ছিনতাই করা হয়। কেউ হয়তো অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তা দিয়ে একা রিকশায় যাচ্ছেন, তখন আরেকটি রিকশায় দু’জন তরুণ অন্য রিকশাটির পাশে এসে একা যাত্রীকে সালাম দিয়ে বলে, ‘কেমন আছেন আংকেল?’

দুই তরুণ রিকশার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ওই যাত্রীকে নিচুগলায় বলে, ‘চিল্লাচিল্লি করবেন না আংকেল, আমাদের সঙ্গে পিস্তল আছে। টাকা-মানিব্যাগ-মোবাইল, যা আছে সব দিয়া দেন।’ যাত্রী প্রাণভয়ে বাধ্য হয়ে সব দিয়ে দেন। ছিনতাইকারীরা আজকাল মোটরবাইকও ব্যবহার করে। তথাকথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অনেকে মোটরবাইক ব্যবহার করে ছিনতাই করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন চক্র

ঢাকা শহরে ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন চক্র রয়েছে। যেমন সালাম পার্টি, যাদের কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। এরা রিকশাযাত্রী বা পথচারীদের টার্গেট করে। আছে মলম পার্টি। এরা ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তির চোখে মলম লাগিয়ে দেয়, ওই ব্যক্তি কিছুক্ষণ চোখে কিছুই দেখেন না। চোখ নিয়ে তাদের অনেক ভুগতে হয়। আমার পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক একবার মলম পার্টির কবলে পড়ে সব হারিয়েছিলেন।

তার চোখের গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল, অনেকদিন লেগেছে চোখ স্বাভাবিক হতে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘পুলিশকে জানাননি কেন, থানায় রিপোর্ট করেননি কেন?’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কী হবে ওসব করে? কোনো লাভ হবে না, পুলিশ কিছুই করবে না, বা করতে পারবে না। পত্রিকায় ঘটনাটি প্রচার হবে, সবাই সহানুভূতি জানাবে, সেটা আরও বিব্রতকর।’

এ ছাড়াও রয়েছে অজ্ঞান পার্টি ও হ্যান্ডশেক পার্টি। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় থাকে প্রধানত বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে। এরা যাত্রীদের একা পেয়ে তার সঙ্গে গল্প করে, ভাব করে, তারপর ওষুধ বা মাদক মেশানো বিড়ি, সিগারেট বা খাবার খাওয়ায়। যাত্রী অজ্ঞান হয়ে গেলে তার সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়।

হ্যান্ডশেক পার্টির উপদ্রব এখন ঢাকা শহর ও অন্যান্য জনবহুল শহরে সর্বত্র। এই ছিনতাইকারী কোনো পথচারী বা রিকশা যাত্রীকে সালাম দিয়ে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। বেশিরভাগ মানুষই মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে সে বোধহয় তার পরিচিত কেউ। করমর্দন করেই ছিনতাইকারী তার ভিকটিমের পেটে ছোট ছুরি বা পিস্তল (খেলনাও হতে পারে) চেপে ধরে বলে, ‘মোবাইল আর মানিব্যাগটা দে তাড়াতাড়ি, নইলে মরবি।’

অসহায় লোকটি প্রাণ বাঁচাতে সব দিয়ে দেয়। ছিনতাইকারী এমন অভিনয় করে যে আশেপাশের লোকজন বুঝতেই পারে না এখানে ছিনতাই হচ্ছে। এ ধরনের আরও অনেক চক্র রয়েছে, যারা অভিনব কায়দায় ছিনতাই করে। দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না।

ছিনতাইকারীদের কলাকৌশল ও অপতৎপরতা নিয়ে অনেক কিছু বলা হলো। কিন্তু এই অপরাধ দমনে পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছে? এ প্রশ্নটি দিয়েই লেখাটি শুরু করেছিলাম।  প্রতিবেদক তার রিপোর্টে নিজেই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন এবং তার সাধ্যমতো তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার সাড়ে পাঁচশ’র বেশি ছিনতাইকারীর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর পুলিশের খাতায় রয়েছে। কিন্তু তারা অধরা রয়ে গেছে। যেহেতু অধরা, তাই তারা শহরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা থানায় যায় না, মামলাও করে না। কারণ তারা জানে মামলা করে লাভ নেই। পুলিশ মামলা নিলেও এমন ধারায় করে যাতে অপরাধী সহজেই জামিন পেয়ে যায়। ছিনতাইয়ের মামলা থানা কর্তৃপক্ষ নিতে চায় না, কারণ এত মামলা রেকর্ড করলে থানার সুনাম নষ্ট হবে!

শুঁটকির নৌকায় বিড়াল পাহারাদার

আরেকটি খারাপ খবর হচ্ছে, বেশ কিছুসংখ্যক ছিনতাইকারীকে পুলিশ তাদের সোর্স হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। এজন্য তারা সোর্সমানি বা ভাতা পায়। সোর্সদের কাজ হচ্ছে ছিনতাইকারী ও অন্যান্য অপরাধী সম্পর্কে পুলিশকে সময়মতো অবহিত করা এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী? সোর্সরা যেহেতু পুলিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত, তাই তারা বেপরোয়া হয়ে নিজেরাই অপরাধ করছে আরও বেশি করে। তারাই এখন বেশি ভয়ঙ্কর। শুঁটকির নৌকায় বিড়ালকে পাহারাদার নিয়োগ করলে যা হয়, তা-ই হচ্ছে।

ঢাকা শহরের প্রত্যেক বাসিন্দা, বিশেষ করে যারা ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলাচল করেন, তারা সবাই ছিনতাইকারীদের হাতে জিম্মি। ছিনতাইয়ের ঘটনা যদিও পুলিশে রিপোর্ট হয় না, তবুও ধারণা করা যায় বিরাট এই নগরীতে প্রতিদিন প্রায় একশ’ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। প্রকৃত সংখ্যা পুলিশ বলতে পারবে, কিন্তু তারা তো বলবে না।

ছিনতাইকারীদের ধরা অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকা নগরীর সাড়ে পাঁচশ’র বেশি সক্রিয় ছিনতাইকারীর তালিকা রয়েছে পুলিশের হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ যদি ইচ্ছা করে, তাহলে পুলিশ, র‌্যাব এবং অন্যান্য বাহিনী নিয়োজিত করে এক রাতের অভিযানেই তালিকাভুক্ত সব ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব। কেন করা হয় না, তার জবাব নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো ব্যাখ্যা বা জবাব আশা করতে পারি কি?

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ