১৯৮৭ সালে নাটোরের গুরুদাসপুর থানায় হামলা চালায় চরমপন্থিরা। হামলাকারীরা এক কনস্টেবলকে খুন করে চরমপন্থিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। লুট করে থানায় মজুত করা অস্ত্র। এ ঘটনার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত চরমপন্থি সাইফুল ওরফে মানিককে (৫৬) গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।
মানিক ৩৪ বছর ধরে শ্রমিকের ছদ্মবেশে পলাতক ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হয়ে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। অবশেষে তাকে শুক্রবার রাতে রূপগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
র্যাব জানায়, মানিক ‘সর্বহারা’ দলের সক্রিয় সদস্য। সর্বহারা দলের নেতৃত্বে পরিচালিত সব কার্যক্রমে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। তিনি নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ এলাকায় ছাত্তার নামে শ্রমিক সরদার হিসাবে কাজ করতেন। ২০১৮ সালে মানিক তার নাম পরিবর্তন করে সাইফুল প্রধান নামে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় ভোটার হিসাবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। রূপগঞ্জ এলাকায় তিনি ছাত্তার নামে পরিচিত ছিলেন। রূপগঞ্জ এলাকার মানুষ তার অপরাধ কার্যক্রম সম্পর্কে জানত না।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৮৭ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার হাটের দিন বেলা ১১টার দিকে একদল চরমপন্থি ছদ্মবেশে লুঙি, গামছা পরা অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। পোটলার মধ্যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র লুকানো ছিল। তাদের কয়েকজন অস্ত্র দেখিয়ে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে। কয়েকজন থানায় জিডি করার উদ্দেশে থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণে নেয়।
‘এ সময়ে থানায় দায়িত্বরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থিরা তাকে গুলি করে হত্যার পর ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। পরে থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুটি এসএমজি, চারটি এসএলআর, ১৮টি রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থি আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এরপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়।’
আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাটোরের গুরুদাসপুর থানায় ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামি গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে গুরুদাসপুর থানা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।
গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মানিক ১৯৮৪ সালে চরমপন্থি নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকা ওরফে সর্বহারা দলে যোগ দেন। চরমপন্থি নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকার যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করতেন। এ বৈঠকে তিনি আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলতেন। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তারা পুলিশ হত্যা করে থানা-ফাঁড়ি লুট করবে বলেও ঘোষণা দিত।
‘১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থি এবং সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নকশালপন্থি ১২ জন নিহত হন। এ ঘটনার পর মানিকসহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যায়। ভোর হলে পুলিশ ১২টি মরদেহ উদ্ধার করে থানায় মামলা করে। ওই ঘটনার মামলায় মানিক গ্রেফতার হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে মানিকের পলাতক জীবন শুরু হয়। থানা লুট ও ১২ জনকে হত্যা মামলাসহ মানিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।’