ত্যাগের উৎসব ঈদুল আজহা

আল্লাহতায়ালার অপার কৃপায় আমরা কুরবানির ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছি। ইসলামে পবিত্র কুরবানির গুরুত্ব অতি ব্যাপক। এর ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অবগত।

আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগের কথা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একজন নবি হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঘরে অতি বৃদ্ধ বয়সে জন্ম নিয়েছিল একটি ছেলে। এ ছেলে ছিল আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মহাদান। তাই খুবই আদরের। নাম তার ইসমাইল।

তিনি যখন তার পিতার সঙ্গে কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হলেন তখন আল্লাহর আদেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.)-কে জবাই করতে উদ্যত হলেন। এ বিষয়টি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)কে ডেকে বলেছিলেন, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছ’ (সূরা সাফফাত, আয়াত : ১০৫)।

হজরত ইবরাহিম (আ.) কিন্তু ছেলেকে জবাই করলেন না অথচ আল্লাহপাক বলছেন, ‘তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছ’। তাহলে কীভাবে সন্তানের কুরবানির স্বপ্ন পূর্ণ হলো এ বিষয়ে আমাদের ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

প্রথম কথা হলো, ধর্মের নামে নরবলি দেওয়ার প্রথা বহু আগ থেকে চলে আসছিল। আল্লাহতায়ালা রক্তপিপাসু নন যে, তার প্রিয় সৃষ্টির রক্তে তিনি তুষ্ট হবেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নের নিজ ব্যাখ্যানুযায়ী সন্তান কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

আল্লাহতায়ালা নরবলি প্রথাকে চিরতরে রহিত করার জন্যই মূলত এ জবাই হতে দিলেন না বরং পরে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে পশু জবাই করলেন। নরবলি পশু বলিতে রূপান্তরিত হলো।

দ্বিতীয়ত হজরত ইবরাহিম (আ.) তার পুত্র ইসমাইলকে শিশু বয়সেই আল্লাহতায়ালার আদেশে মক্কার নিবিড় অরণ্যে তার মাতা হজরত হাযেরাসহ পরিত্যাগ করে এসেছিলেন। এর ফলে পরবর্তীকালে সেখানে আল্লাহর পবিত্র ও প্রাচীন কাবা ঘরের সংস্কার হলো এবং মক্কা নগরী প্রতিষ্ঠিত হলো।

আর সেখানে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশে আবির্ভূত হলেন বিশ্ব নবি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। এ মহান পরিকল্পনাকে দৃষ্টিপটে রেখে মহান আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ মহান কুরবানিকে তার কাছ থেকে কুরবানি গ্রহণ করেছিলেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ মহান কুরবানিকে দুনিয়ার সামনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে আল্লাহতায়ালা স্বপ্নে এ আদেশ দিলেন আর অমনি হজরত ইবরাহিম (আ.) ‘আসলামতুলি রাব্বিল আলামিন’ বলে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। মহান কুরবানির এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর সৃষ্টি হলো দুনিয়াতে।

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ কুরবানির আত্মা এবং শক্তি নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নবি করিম (সা.) তার উম্মতকে পশু কুরবানির আদেশ দিলেন। তাই বিশ্বের প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমান প্রত্যেক বছর ১০ জিলহজ তারিখে কুরবানি করে থাকে।

হজরত ইসমাইল (আ.) যেভাবে পিতার ছুরির নিচে মাথা পেতে দিয়েছিলেন, কুরবানির পশু যেভাবে ছুরির নিচে মাথা পেতে দেয় তেমনই প্রত্যেক মুসলমানের এ প্রতিজ্ঞা হওয়া আবশ্যক যেন ধর্মের খাতিরে ইসলামের পথে তারা নিজেদের এভাবে কুরবানি করে দিতে পারে। আবার কুরবানির পশুর মতো নিজেদের পশুত্বকে বলি দেওয়ার শিক্ষাও আমরা কুরবানি থেকেই পেয়ে থাকি। কেবল গোশত খাওয়াই এ কুরবানির উদ্দেশ্য নয়। আর এতে আল্লাহর কাছে আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই।

আল্লাহপাক বলেছেন, ‘এগুলোর মাংস বা এদের রক্ত কখনো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তার কাছে তোমাদের পক্ষ থেকে তাকওয়া পৌঁছে’ (সূরা হজ, আয়াত : ৩৭)।

সুতরাং হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত অনুযায়ী নবি করিম (সা.)-এর নির্দেশে কুরবানি পালনের মাধ্যমে প্রতি বছর একজন মুসলমান নিজের মাঝে তাকওয়াকে আর একবার ঝালিয়ে নেন যেন প্রয়োজনের দিনে আল্লাহর পথে কুরবানির পশুর মতো নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন।

প্রসঙ্গত কুরবানির শিক্ষা ও তাৎপর্য না বোঝার কারণে কেউ কেউ কটূক্তি করে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে কুরবানি একদিকে যেমন অপচয় অর্থাৎ একদিনে সারা বিশ্বে লাখ লাখ পশু জবাই করে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনের ঘাটতি সৃষ্টি করা হচ্ছে অন্যদিকে একটা অবোধ পশুকে আল্লাহর নামে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে।

আপাত দৃষ্টিতে উপরোক্ত উক্তি সঠিক বলে মনে হলেও গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে এটা বোকার উক্তি বলে প্রতীয়মান হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, আল্লাহতায়ালা যেসব বস্তু হালাল অর্থাৎ বৈধ করেছেন এর মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে বরকত ও প্রবৃদ্ধি রেখে দিয়েছেন। আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই গরু, ছাগল প্রভৃতির বাচ্চা উৎপাদনের হার কুকুর, শূকর ইত্যাদির চেয়ে কম।

কুরবানি এবং ‘মাংস নিষেধ দিবস’ ছাড়াও প্রতিদিন বিশ্বে লাখ লাখ গরু ছাগল ইত্যাদি জবাই হচ্ছে। তবুও আমরা দেখতে পাই পশু পালকের পালন নিঃশেষ হয় না। অথচ বহুগুণে কুকুর শূকর পয়দা হলেও (মুসলমানের জন্য এগুলো যদিও নিষিদ্ধ) এদের সংখ্যা তুলনামূলক কমই দেখা যায়। রাস্তাঘাট তো কুকুর শূকর প্রভৃতিতে ভর্তি থাকার কথা। যেভাবে গুরু ছাগল প্রভৃতি খাওয়া হয় আল্লাহ যদি এগুলোতে বরকত না দিতেন তাহলে এ প্রজাতিগুলো বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিত কেননা এদের খাবার সংকট দেখা দিত।

মানুষ সৃষ্টির সেরা। তার সেবায় জীব-জন্তু বৃক্ষ তরুলতা থেকে আরম্ভ করে সবকিছু নিয়োজিত, এদের কুরবানিতে মানব জীবন বাঁচে এবং এদের জীবন হয় সার্থক। এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহ এদের সৃষ্টি করেছেন। তবে এদের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য রয়েছে আমরা তা যেন ভুলে না যাই।

অতএব, প্রকৃতির মাঝে কুরবানি ও ত্যাগের মহিমাই যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ভাবেই আল্লাহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।

কুরআন, হাদিস এবং বুজুর্গানে দ্বীনের ভাষ্য থেকে যতটুকু জানা যায় কুরবানির পেছনে যে উদ্দেশ্যটি কাজ করা আবশ্যক তা হলো তাকওয়া বা খোদার সন্তুষ্টি। হজরত ইবরাহিম (আ.) তার একমাত্র পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে খোদার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করতে উদ্যত হয়েছিলেন। যে কুরবানির পেছনে এ উদ্দেশ্য ও আত্মা কাজ করে না সে কুরবানি, কুরবানির আওতায় পড়ে না।

আমরা অনেক সময় দেখি নাম ফলানোর জন্য বা লোক দেখানো ভাব নিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কুরবানি করা হয়, যা মোটেও ঠিক নয়। আমাদের কুরবানি হবে কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবরাক।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ