তুরস্কের গর্ব ঐতিহাসিক স্থাপনা এখন ধ্বংসস্তূপ

বিধ্বংসী ভূমিকম্প তুরস্কের হাজার হাজার প্রাণ কেড়েই ক্ষান্ত হয়নি। দেশটির দশটি প্রদেশের ৭৫ শতাংশ স্থাপনা চুরমার করে দিয়েছে। বাকিগুলোতেও ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে।

কোনো কোনোটা হেলে পড়েছে। তুরস্কের গর্ব ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। দুই হাজারের বছরের পুরোনো কেল্লা, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু হাতায় প্রদেশেই নয়, অন্য নয়টি প্রদেশেও ঐতিহাসিক অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কেল্লাসহ বেশ কয়েকটি মসজিদ, স্থাপনায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্থাপনাগুলো নিয়ে স্থানীয়দের নানা গল্পগাথা রয়েছে। ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড় থাকত; এখন জনমানবশূন্য। স্থাপনাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অন্যত্র উদ্ধার তৎপরতা চোখে পড়লেও এখানে উদ্ধারকর্মীদের দেখা যায়নি।

ঐতিহাসিক স্থাপনগুলো নিয়ে মানুষের দুঃখ ও আফসোসের শেষ নেই; স্থানীয়দের শোকাহত করে তুলেছে। কারণ এসব স্থাপনা ঘিরে তুরস্কের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। স্থানীয়রা জানান, এ স্থাপনাগুলো তাদের গর্বের বিষয় ছিল।

সিরিয়া সীমান্তঘেঁষা তুরস্কের হাতায় প্রদেশ এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। উদ্ধার লাশগুলো গণকবরে একের পর দাফন করা হচ্ছে। কবরের শীর্ষদেশে মৃত মানুষের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও মৃত্যুর তারিখ অভিন্ন-৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

এদিকে, তুরস্ক-সিরিয়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ১৩ দিন পর শনিবারও ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ মিলছে। এদিন তুরস্কে এক শিশুসহ তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। দুই দেশে মৃত্যু ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে দুই দেশই মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়। ধ্বংসস্তূপে অনেক লোক চাপা পড়ে থাকায় এখনও উদ্ধার কাজ চলছে।

ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশের গন্ধ বের হচ্ছে। তুর্কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার দেশে এখন পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৬৭২ জন মারা গেছেন। সিরিয়া সরকার এবং জাতিসংঘ বলছে, সিরিয়ায় ৫ হাজার ৮০০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন।

ভূমিকম্পের ২৭৮ ঘণ্টা পর তুরস্কের হাতায় প্রদেশের ধ্বংসস্তূপ থেকে ৪৫ বছর বয়সি একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে সময় যত বাড়ছে জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে।

তুরস্কের প্রতি কিলোমিটারে কোথাও চারটি, কোথাও সাতটি মসজিদ। প্রাচীন ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এসব মসজিদ নির্মিত। ভূমিকম্পে বেশিরভাগ মসজিদ ভেঙে যাওয়ায় মানুষ খোলা আকাশে নিচে নামাজ পড়ছেন। হাতায় প্রদেশের প্রাণকেন্দ্র আনতাকিয়া উপশহরের ঐতিহাসিক প্রাচীন মসজিদ হাবিব-ই নাজ্জার ভেঙে গেছে।

মসজিদটিতে সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকত। আনাতোলিয়ার প্রথম মসজিদ হিসাবে পরিচিত স্থাপনাটি প্রায় ১৪০০ বছর আগে নির্মিত। সব প্রদেশেই ঐতিহাসিক অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ঘেরা প্রতিটি প্রদেশের অনেক পাহাড়ও ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। তবে হাতায় ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ি এলাকায় শুধু ধ্বংসস্তূপ।

কোনো কোনো প্রদেশে ফুটবল মাঠকে গণকবরে পরিণত করা হয়েছে। ভূমিকম্পের পর থেকে এ পর্যন্ত হাতায় প্রদেশে ১৭ হাজার মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি গণকবর ঘুরে দেখা গেছে-পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি দূরত্বে কাঠের তক্তা লম্বালম্বিভাবে পোঁতা। কোনো কোনো তক্তার মাথা বিভিন্ন রঙের কাপড়ে মোড়া। প্রতিটি তক্তাতে মৃত মানুষের নাম লেখা। সবার মৃত্যুর তারিখ এক : ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

স্থানীয় সূত্র জানায়, তুরস্ক সরকার প্রতিটি মুহূর্তেই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত হাতায় প্রদেশের আতাতুর্ক সড়কের দুইপাশে প্রায় ৩০-৪০টি উদ্ধারকারী দল উদ্ধার কাজ চালায়। এতে বাংলাদেশ সেনা সদস্যরাও অংশ নেন। উদ্ধারকারীরা জানান, হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে। তবে সমানতালে উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

গাজি আনতেপে সরেজমিন দেখা যায়, শহরের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা দুই হাজার বছরের পুরোনো কেল্লাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ অংশ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। কেল্লা প্রাচীর ভেঙে গেছে। শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত কেল্লাটি ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত। হিটাইট সাম্রাজ্যের সময় কেল্লাটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

এ কেল্লার নাম তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। গাজি আনতেপ ডিফেন্স অ্যান্ড হিরোইজম প্যানোরামিক মিউজিয়াম হিসাবেও এটি ব্যবহৃত হতো। এখানে সব সময় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকত। এটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ৮০ বছরের ওসমান গোকওউলু জানান, ভূমিকম্পে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। হাতায় প্রদেশের হাবিব-ই-নাজ্জার মসজিদ, গাজি আনতেপ কেল্লাসহ শত শত ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। এগুলো আমাদের শক্তি ছিল, প্রেরণা ছিল, প্রেরণার উৎস ছিল। গর্ব করার বিষয় ছিল।

১৩ দিন পর তুরস্কে তিনজনকে জীবিত উদ্ধার : ভূমিকম্পের ১৩ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে এক শিশুসহ তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করেছে তুরস্কের উদ্ধারকারীরা। স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, হাতায় প্রদেশের রাজধানী আন্তাকিয়ার কানাটলি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের নিচে ২৬৯ ঘণ্টা চাপা ছিলেন তিনজন।

উদ্ধারের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফুটেজে দেখা যায়, উদ্ধারকারীরা একজন পুরুষ ও একজন নারীকে স্ট্রেচারে করে একটি অপেক্ষমাণ অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের পাশেই এক শিশুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসকদের কাছে। তুরস্কের সম্প্রচার মাধ্যম টিআরটি জানায়, একই ভবন থেকে আরও অনেককে জীবিত উদ্ধারের আশা করা হচ্ছে।

এ জন্য অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রস্তুত ছিল। এদিকে, ঘানার ফুটবল খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ান আতসুকে শনিবার দক্ষিণ তুরস্কে তার বাসভবনের নিচে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অতসুর তুর্কি ক্লাব হাতায় পোর টুইটারে লেখে, ‘আমরা তোমাকে ভুলব না, অতসু। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ