সাড়ে ছয় বছর পর ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশে আগামীকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। এই পরিস্থিতির পাশাপাশি প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে বড় নিয়ামক নারী ভোটার। আর কয়েকজন আলোচিত প্রার্থীর জন্য কোচিং সেন্টারকেন্দ্রিক সমর্থকগোষ্ঠী ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গতকাল রোববার ছিল প্রচারণার শেষ দিন। এদিনও সব প্রার্থীর নজর ছিল নারী ভোটারদের নজর কাড়ার দিকে। ডাকসুতে এবার মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ ছাত্রী। ফলে বড় পদগুলোর প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান গড়ে দিতে পারেন ছাত্রীরাই।
ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯, যা মোট ভোটারের ৪৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ছাত্রীদের পাঁচটি আবাসিক হলের মধ্যে শুধু রোকেয়া হলেই পাঁচ হাজার ৬৬৫ ভোট। এ ছাড়া বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে দুই হাজার ১১০টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে দুই হাজার ৬৪৫, শামসুন নাহার হলে চার হাজার ৯৬ এবং কবি সুফিয়া কামাল হলে ভোটার চার হাজার ৪৪৩টি।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় প্রথম থেকেই গুরুত্ব পাচ্ছে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা। নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন সব প্যানেলের প্রার্থীরা। একই সঙ্গে নারীরা যাতে সাইবার বুলিংয়ের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার কথাও বলছেন সবাই।
ছাত্রদলের প্যানেলের ইশতেহারে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি হলে স্বাস্থ্যসেবা ইউনিট, মেডিকেল সেন্টারে নারী চিকিৎসক, সান্ধ্য আইন বিলোপ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
ছাত্রশিবিরের প্যানেলের ৩৬ দফা ইশতেহারে সাতটিতে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বাগছাসের প্যানেলের ইশতেহারে নারীদের হলগুলোতে খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, ২৪ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মেয়েদের নামাজের স্থান সম্প্রসারণ, অনাবাসিক ছাত্রীদের হলে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, জনপরিসর নারীবান্ধব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
উমামা-সাদী প্যানেল তাদের ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করা, আইনি সহায়তা সেল গঠন, সাইবার সিকিউরিটি সেল গঠন, অনলাইন-অফলাইনে নিপীড়ন বা বুলিংয়ের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিরোধ পর্ষদের প্যানেলের ইশতেহারে নারীবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি আছে।
বিভিন্ন প্যানেল যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তা পর্যালোচনাও করছেন ছাত্রীরা। তারা বলছেন, যাদের ভোট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিরাপদ হবে, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে এবং সংঘাত কমবে– এমন প্রার্থীদের তারা বেছে নেবেন। পাশাপাশি নিরাপদ ক্যাম্পাস, মতপ্রকাশ ও পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ছাত্রীদের বড় চাওয়া।
নির্বাচনে ভিপি পদে ছাত্রীদের ভোট বেশি পাবেন কে, কোন হলের ভোট কার পক্ষে যাবে, কার দিকে ঝুঁকবেন জগন্নাথ হলের বিপুল সংখ্যক ভোটার– এমন নানা আলোচনার ফাঁকে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংয়ে পড়ান এমন প্রার্থীরা। বিশেষ করে ভিপি পদে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের সমীকরণ মেলাতে ‘কোচিং ফ্যাক্টর’ সামনে আসছে।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং ইউসিসিতে ক্লাস নেন। তিনি এ কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও যুক্ত। আবার ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে মূলত ছাত্রশিবির। সেখান থেকেও অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সাদিক কায়েম সেখানে তাঁর সুযোগ দেখছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেনও ইংরেজি পড়িয়ে ক্যাম্পাসে বেশ জনপ্রিয়। তাঁরও রয়েছে ‘ভোট ব্যাংক’।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, ফোকাস ও ইউসিসিতে কোচিং করে সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে ফোকাস থেকে এক হাজার ৭৫০ জন এবং ইউসিসি থেকে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। সেই হিসাবে গত তিন বছরে এ দুই কোচিং সেন্টারে ক্লাস করা অন্তত আট হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন এখানে। তারা সবাই এ নির্বাচনে ভোটার।
সরাসরি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইংরেজি পড়ান স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন। ফেসবুকে তাঁর বিপুল ফলোয়ার। তারা চাকরির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিখতে শামীমের ভিডিও ক্লাস দেখেন নিয়মিত। বিভিন্ন ব্যাচে শামীমের অনেক শিক্ষার্থী আছেন।
শেষ দিনের জমজমাট প্রচারণা
এবারই প্রথম ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া নির্বাচন হচ্ছে। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও প্রভাব রাখছেন ভোটের মাঠে। ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা যায়, দিনভর একাডেমিক ভবন এলাকায় হ্যান্ডবিল, লিফলেট নিয়ে জনসংযোগ করছেন প্রার্থীরা। সন্ধ্যা নামতে অনেকে আবাসিক কক্ষে কক্ষে গিয়ে পরিচয়, ব্যালট নাম্বার জানিয়ে দিচ্ছেন। এক কথায়, প্রচারণার শেষ দিনে জমজমাট ছিল ক্যাম্পাস।
প্রচারণার শেষ দিনে ঐতিহাসিক বটতলার প্রাঙ্গণে বুকে হাত দিয়ে শপথ নিয়েছেন ছাত্রদলের প্যানেলের ডাকসু এবং হল সংসদের প্রার্থীরা। তাদের শপথ পাঠ করান ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। প্রতিনিধি নির্বাচিত হলে ডাকসুর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশে শিষ্টাচার, সৌজন্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ও আচরণে গণতান্ত্রিক মনোভাব বজায় রাখাসহ আটটি বিষয় ছিল এই শপথে।
প্রচারণাকালে মধুর ক্যান্টিনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবদুল কাদের বলেন, আপনারা অবশ্যই ভোট দিতে আসবেন। যাকে খুশি তাঁকে ভোট দিন, তবে যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেবেন। ব্যালটের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা যোগ্য প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন বলে আশা জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ৯ সেপ্টেম্বর কোনো ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং হয় কিনা। কারণ আমরা দেখেছি, ছাত্রলীগ কীভাবে ক্যাম্পাসকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এবার আবার নতুন করে কেউ একই কাজ করে কিনা, সেটি নজরদারিতে রাখতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে এজিএস প্রার্থী আশরেফা খাতুনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থ অবস্থায় হুইল চেয়ারে করে হাসপাতাল থেকে এসে ক্যাম্পাসে প্রচারণা চালিয়েছেন বামপন্থি সাতটি সংগঠনের প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। পরে মধুর ক্যান্টিনে তিনি বলেন, ৯ তারিখে নির্বাচনের ফল যাই হোক, আমরা ইতোমধ্যে জিতে গেছি। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোটে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা যাকে খুশি তাকে ভোট দিন। কিন্তু আপনারা অবশ্যই ভোট দিতে আসবেন। আপনারা ভোট দিতে এলে এখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা পোস্টেও জিতে আসতে পারবে না।
শিক্ষার্থীবান্ধব প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রত্যাশা ভোটারদের
ডাকসু নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী সানজিদা আলম প্রভা বলেন, শিবির, ছাত্রদল কিংবা বাগছাস না দেখে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক– এটাই চাই। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে প্রত্যাশা হলো, তারা যে কোনো মাতৃসংগঠনের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজের স্বতন্ত্রতা যেন বজায় রাখে।
ইংরেজি বিভাগের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাহসিন আলম বলেন, আমি চাই ডাকসু নিয়মিত হোক। তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারের জায়গা বুঝে নিতে পারবে। আর যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তারা তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হবেন। তবে তারা যেন রাজনৈতিক সহাবস্থান তৈরি করেন, কোনো বিরোধে না জড়ান।
নিয়মিত ডাকসু হলে সংকট থাকবে না, বলছেন শিক্ষকরা
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানার প্রত্যাশা, ডাকসুর ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম এই সংগঠক সমকালকে বলেন, ভোট যেন সুষ্ঠভাবে হয় এবং ছাত্র-ছাত্রীরা যেন নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে। গণতান্ত্রিক ভারসাম্য, ভিন্নমত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ইশতেহারগুলো দেখে মনে হয়েছে, ভোট পেতে পপুলিস্ট প্রস্তাবনা জোর পেয়েছে। কেউ অবকাঠামো তৈরির ওয়াদা দিচ্ছে, আবার কেউ শিক্ষক নিয়োগে ভূমিকা রাখার কথা বলছে। কেউ বলছে শিক্ষার্থীদের জীবনমান পরিবর্তন করে ফেলবে। কিন্তু একটা ডাকসুর মেয়াদ হয় এক বছর তিন মাস। এই সময়ে সবকিছু পরিবর্তন করা ফেলা সম্ভব না। তাই শিক্ষার্থীদের জরুরি প্রয়োজনগুলো নিয়ে তাদের সক্রিয় থাকা উচিত।
গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান নির্বাচন কমিশনের
কোনো ধরনের গুজবে কান না দিয়ে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে আসতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম উদ্দিন। রোববার বিকেলে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, গুজব মারাত্মক ব্যাধি। শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, নির্ভয়ে ক্যাম্পাসে এসে যাতে ভোট দিয়ে তাদের নেতৃত্ব ঠিক করে নেয়।
অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, আগে আট কেন্দ্রে ৭১০ বুথ ছিল। সেটি বাড়িয়ে ৮১০টি করা হয়েছে। যাতে আবাসিক, অনাবাসিক ভোটারদের কোনোভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হতে না হয়।





