দেশের বিভিন্ন স্থানে শীত জেঁকে বসেছে। বইছে হিমেল হাওয়া। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে চারপাশ। কোথাও কোথাও সারা দিনই সূর্যের দেখা মিলছে না। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা কমে আশায় সড়ক, নৌ ও বিমানপথে যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটছে। বৃহস্পতিবার কুয়াশাচ্ছন্ন সড়কে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। ফরিদপুরের ভাঙ্গার ট্রাকে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় দুই মেয়েসহ প্রাণ যায় মায়ের।
এছাড়া আরও কয়েকটি দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। কোথাও কোথাও দিনেও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু সেতুতে কয়েক দফায় টোল আদায় বন্ধ রাখা হয়।
এতে ওই সড়কে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কুয়াশার কবলে মেঘনায় কয়েকটি লঞ্চ মাঝ নদীতে আটকা পড়ে। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে কয়েক ঘণ্টা দেরি হয় যাত্রীদের।
রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গায় বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। রাজশাহীতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
কনকনে শীতে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে বের হলেও কাজ পাচ্ছেন না। ঠান্ডাজনিত অসুখে ভুগছে শিশু ও বয়স্করা। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ভাঙ্গা (ফরিদপুর) : বৃহস্পতিবার ভোর ৭টায় ভাঙ্গা উপজেলার শলিলদিয়ায় ট্রাকের পেছনে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় দুই মেয়েসহ মা নিহত হয়েছেন। এসময় প্রাইভেটকারটি ট্রাকের পেছনে ঢুকে পড়ে।
নিহতরা হলেন-ভাঙ্গা পৌরসভার আতাদি গ্রামের জুয়েল শেখের স্ত্রী লুবনা আক্তার (৪০), তার মেয়ে জুরাইয়া আক্তার (১৬) ও জয়নব (৩)। জুয়েল শেখ প্রাইভেটকার চালাচ্ছিলেন।
তিনিসহ দুজন এ সময় আহত হন। তারা কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। এ ঘটনায় জুয়েল শেখের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে।
শিবচর হাইওয়ে থানায় এসআই জুয়েল জানান, ঘন কুয়াশা ও দ্রুতগতিতে প্রাইভেটকার চালানোর কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাইভেটকারটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
ঘটনাস্থলেই মা লুবনা এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর তার দুই মেয়ে মারা যায়।
টাঙ্গাইল ও ভূঞাপুর : বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার ভোরে কয়েক দফা বঙ্গবন্ধু সেতু টোল প্লাজার বুথ বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব থেকে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকায় যানজট হয়। উত্তরবঙ্গগামী ট্রাক চালক রহিজ উদ্দিন ও রায়হান মণ্ডল জানান, কুয়াশায় গাড়ির লাইটের আলো বেশি দূর পৌঁছায় না। ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হয়। এলেঙ্গা এসে কয়েক ঘণ্টা ধরে যানজটে আটকা পড়ি। সকাল ৯টার পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
রাজশাহী : জেলায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা কমেছে। আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরুরি সতর্কীকরণ বুলেটিনে বলা হয়েছে-এদিন দুপুরের পর থেকে রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, নীলফামারী ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এটি উত্তরের আরও কয়েকটি জেলায় বিস্তার লাভ করতে পারে। চলমান শৈত্যপ্রবাহ থাকতে পারে ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত। ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
লালমোহন (ভোলা) : ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা বেশ কয়েকটি লঞ্চ বুধবার রাত ৩টায় মুন্সীগঞ্জের কাটপট্টি এলাকায় এলে ঘন কুয়াশার কবলে পড়ে। এরপর আর সামনে এগোতে পারছিল না। পরে সেখানেই আশপাশে নোঙ্গর করে রাখে লঞ্চগুলো। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার আগে অধিকাংশ লঞ্চ সদরঘাট পৌঁছতে পারেনি। এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর-৮ লঞ্চের কয়েকজন যাত্রী জানান, সকাল ৬টার মধ্যে তাদের সদরঘাট পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু পৌঁছেন বেলা ১১টায়। একই লঞ্চের সুপারভাইজার শামিম জানান, ঘন কুয়াশার কারণে নদীতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এ কারণে আমরা লঞ্চ নোঙ্গর করে রাখি।
কুড়িগ্রাম ও চিলমারী : জেলায় সারা দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। গাড়ি চলেছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। হিমেল হাওয়া আর ঠান্ডা বাতাসে যবুথবু অবস্থা ছিল বাসিন্দাদের। কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের বলতি পাড়া গ্রামের কৃষি শ্রমিক শাহেব আলী ভোরে যুগান্তরকে বলেন, এত ঠান্ডায় মানুষ তো বিছানা থেকেই উঠেনি, আর আমরা কাজের জন্য মাঠে যাচ্ছি। ওই এলাকার মিনা বেগম বলেন, ঠান্ডায় বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, আমার ইউনিয়নে ৫-৬ হাজার দুস্থ ও অসহায় মানুষ আছেন। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে মাত্র ৭০০ কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) : তীব্র ঠান্ডায় ভোগান্তিতে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষ, চা শ্রমিক ও কৃষকরা। এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে অনেককে। প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হননি। চাকরিজীবী আব্দুল জব্বার বলেন, মোটরসাইকেল চালালে শীত আরও বেশি মনে হয়।
একেবারে বুকে এসে বাতাসের ধাক্কা লাগে। তার ওপর বৃষ্টির ফোঁটার মতো রাত থেকে পড়ে ঘন কুয়াশা। ৫ হাত সামনের দূরত্বও স্পষ্ট দেখা যায় না।
শেরপুর : প্রচণ্ড ঠান্ডায় রাস্তাঘাটে জনসমাগম কম দেখা গেছে। কুয়াশার দাপটে সড়ক ও মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে ধীরে। বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগবালাই। ছিন্নমূল মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
গাইবান্ধা : সারা দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরাঞ্চলে ঠান্ডায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ হয়নি। গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাঁপানি, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, পেটের পীড়া, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
মাধবপুর (হবিগঞ্জ) : ঘন কুয়াশায় দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপ ভ্যানে ট্রাকের ধাক্কায় হাঁসের খামারি রহমত উল্লাহ (৫০) নিহত হয়েছেন। তিনি চুনারুঘাট উপজেলার তাউসী গ্রামের মৃত ছামির উদ্দিনের ছেলে। বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নোয়াপাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) : কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কে কোদালিয়া রাস্তার মোড়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে রানা মিয়া (৩৪) নামের একজন নিহত হয়েছেন। তিনি বাজিতপুর এলাকার মুসলে উদ্দিনের ছেলে।
দাগনভূঞা (ফেনী) : বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত হয়েছে। বুধবার বিকালে দাগনভূঞা-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের এনায়েতভূঞায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আবদুল হান্নান অভি (১৩) দাগনভূঞা উপজেলার ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের বরইয়া গ্রামের আবদুল হালিমের ছেলে।