‘ছেলেটা আমার বাঁচার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সব শেষ’

বাচ্চু মিয়া। ৫ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। অভাবের সংসারে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি বেশিদূর।  ৫ম শ্রেণি পড়া বাচ্চু মিয়া ৩০ বছর ধরে গার্মেন্টসে চাকরি করছেন।

নিজে পড়াশোনা করতে না পারার আক্ষেপ ঘুচাতে দুই ছেলেকে নিয়ে ছিল তার অনেক স্বপ্ন। শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। ভালো চাকরি করবেন। এজন্য কষ্টের মধ্যেও দুই ছেলেকে মানুষ করতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। বড় ছেলে সাব্বির আহম্মেদ রকিকে পড়াচ্ছিলেন ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ট্রেড অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইএসটিটি) বিবিএ।  আর ছোট ছেলে ভাসানটেকের একটি স্কুলে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে।

বাচ্চু মিয়ার আশা ছিল, পড়ালেখা শেষ করে বড় ছেলে সাব্বির ভালো চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সেই আশা কেড়ে নিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৩ জুলাই বিকেল সোয়া ৪টার দিকে বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির ও তার দুই বন্ধু মোটরসাইকেল নিয়ে কাফরুল থানাধীন মিরপুর-১৩ পুলিশ স্টাফ কলেজের মেইন গেটের বিপরীত পাশে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় পেছন দিক থেকে ডিএনসিসির ময়লাবাহী গাড়ি সাব্বিরের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। গুরুতর আহত সাব্বিরকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় রাতেই সাব্বিরের বাবা বাচ্চু মিয়া কাফরুল থানায় মামলা করেন।

 

মামলার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির চালক আব্দুস সালামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৪ জুলাই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার আব্দুস সালামের জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবী। কিন্তু ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।

মামলা সম্পর্কে ভিকটিম সাব্বিরের বাবা বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘অভাবের কারণে নিজে বেশি পড়াশোনা করতে পারিনি। এজন্য গার্মেন্টসে চাকরি করে কষ্ট করে ছেলে দুটোকে মানুষ করার চেষ্টা করছি। ছেলেটা আমার কষ্ট বুঝতো। ওর মাকে বলতো, পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। সংসারে আর কষ্ট থাকবে না। কিন্তু সেই ছেলেটার প্রাণটা কেড়ে নিলো।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আমি তিন দিন ঘটনাস্থলে গিয়েছি। দেখি কেউ বলে কি না আমার ছেলের নিজের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে কি না-কিন্তু কেউ বলেনি, মোটরসাইকেল চালকের দোষ ছিল। প্রথমে ব্রেক করলে আল্লাহ চাইলে ছেলেটা বেঁচে যেতো। কিন্তু তা না করে ১০০/১৫০ গজ দূরে তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেছে। ছেলেটা আমার বাঁচার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঘাতক গাড়িচালক তাকে বাঁচতে দিলো না।’

 

বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে কারো বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কিন্তু দুঃখ আমার ছেলেটা যখন দুর্ঘটনা করে রাস্তায় পড়ে ছিল, তখন কেউ একটু সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। দূর থেকে সবাই দেখছে, কেউ ফেসবুকিং করছে।  শুনেছি, দুর্ঘটনার পর ছেলেটা নড়াচড়া করছিল। তখন যদি কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতো। ছেলেটা বেঁচেও যেতে পারতো।’

ঘটনায় দোষীর দৃষ্টান্তমূলক সাজা চান বাচ্চু মিয়া। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক ভাস্কর রায় বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। আসামি গাড়ির চালক আব্দুস সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’

 

তিনি বলেন, ‘ঘটনার জন্য উভয়পক্ষেরই দোষ আছে। ভিকটিমসহ তিনজন একই মোটরসাইকেলে ছিল। কিন্তু তাদের কারো মাথায় হেলমেট ছিল না। আর চালক ইউটার্ন নেওয়ার সময় গারি স্লো করেননি। দ্রুত গতি ছিল। ভিকটিম চাকার নিচে চলে গেলেও চালক গাড়ি থামায়নি। সবকিছু নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আদালতে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী সাজেদা বেগম (ঝুমুর) বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছে অনিচ্ছাকৃতভাবে। কোনো চালক কাউকে মেরে ফেলতে চায় না। আর দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলটি গাড়ির পেছনের চাকায় লেগেছে। চালকের দোষ থাকতো যদি দুর্ঘটনাটি মুখোমুখি ঘটতো। কিন্তু তা তো ঘটেনি। আর মোটরসাইকেলে তিন যুবক বেপরোয়াভাবে চলছিল। তাদের হেলমেটও ছিল না। আব্দুস সালাম ঘটনাটি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটাননি। তিনি একজন বয়স্ক লোক। ঘটনাটি দুঃখজনক। তবে একজনের দায়ে অন্যজন যেন ভিকটিম না হন- সেই প্রত্যাশা করছি।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ