গাজা যুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা : আত্মবিশ্বাসী হামাস

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ‘আত্মবিশ্বাসী যে তারা গাজা উপত্যকায় জয়ী হতে যাচ্ছে।’ হামাস সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ব্যাপারে যেসব সংশোধনী দিয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে মার্কিন প্রতিরক্ষা থিঙ্ক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর দি স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এবং ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্ট (সিটিপি) এই মন্তব্য করেছে।

আইএসডব্লিউ/সিটিপি তাদের গাজা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘সিনিয়র হামাস কর্মকর্তারা বার বার এই আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেছে যে ইসরাইলের সামরিক চাপ সত্ত্বেও এই যুদ্ধে হামাস টিকে যাবে।’

যুদ্ধ নজরদারি গ্রুপ দুটি জানায়, ‌’পুরো গাজা উপত্যকায় হামাস বাহিনীর যুদ্ধ শক্তি কার্যকর রয়েছে, তারা নিজেদের পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছে। হামাস গাজার অনেক এলাকায় তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নতুন করে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে।’

তারা আরো জানায়, ইসরাইলি বাহিনী বৃহস্পতিবার গাজা সিটির জেইতুন ও সাবরা এলাকায় সপ্তাহব্যাপী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে। আর ইসরাইল এ নিয়ে অন্তত পাঁচবার এখানে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করল।

হামাস যোদ্ধারা বৃহস্পতিবার নেতজারিম করিডোরজুড়ে ইসরাইলি বাহিনীর ওপর রকেট ও মর্টার হামলা করে। এছাড়া রাফার পশ্চিমে ইসরাইলি বাহিনীর ওপর মর্টার বর্ষণ করে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে।

এছাড়া ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ ইসরাইলের আশদদ ও আশকেলন নগরীতে রকেট হামলা চালায়। ইসরাইলের আরো কয়েকটি নগরী মর্টার হামলার শিকার হয়।

গাজা যুদ্ধ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রক্রিয়া ‘শেষ’ করতে চাওয়ার ঘোষণার মধ্যে মারাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড কাঁপছে।

যদিও মধ্যপ্রাচ্য সফর সমাপ্ত করে শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিক এন্টনি ব্লিঙ্কেন বুধবার বলেছেন, গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে একটি যুদ্ধবিরতি এবং পণবন্দী মুক্তির চুক্তি এখনও সম্ভব।
হামাসের মিত্র লেবাননের ইরান-সমর্থিত প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরাইলে রকেট হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর একজন সিনিয়র কমান্ডার নিহত হওয়ার একদিন পর তারা এই হামলা চালায়।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গাজা যুদ্ধবিরতি রোডম্যাপ প্রচারের জন্য একটি সফরের শেষ পর্যায়ে দোহায় ব্লিঙ্কেন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘চুক্তিটি শেষ করতে’ আঞ্চলিক অংশীদারদের সাথে কাজ করবে।

হামাস মঙ্গলবার মধ্যস্থতাকারী কাতার এবং মিসরের কাছে তাদের প্রতিক্রিয়া জমা দিয়েছে এবং ব্লিঙ্কেন বলেছেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীর কিছু ‘কার্যযোগ্য এবং কিছু সম্পাদনযোগ্য নয়’।

হামাসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা ওসামা হামদান বলেছেন, তারা ‘একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরাইলি সৈন্যদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছে।’ ইসরাইল এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং আরব শক্তিগুলোর অনুমোদিত তিন-পর্যায়ের পরিকল্পনায় ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি, পণবন্দী বিনিময় এবং গাজার আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত পুনর্গঠন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, হামাসের ‘অনেক’ দাবি ‘ছোট এবং অপ্রত্যাশিত নয়’। অন্যদিকে ‘অন্যান্য দাবি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনে যা উল্লেখ করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি আলাদা।

ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ইসরাইল এই পরিকল্পনার পিছনে ছিল, তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সরকারের উগ্র ডানপন্থী সদস্যরা এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে।এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে সমর্থন করেনি।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, দেশটির উত্তরের (লেবানন) পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং পণবন্দী মুক্তির ইস্যুতে হামাসের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আলোকে’ তিনি বুধবার একটি ‘নিরাপত্তা মূল্যায়ন’ বৈঠক আহ্বান করছেন।

ব্লিঙ্কেন আশা প্রকাশ করেছেন, চুক্তির মতপার্থক্যগুলোর নিরসন করা যেতে পারে।
তিনি বলেন ‘আমাদের দেখতে হবে আগামী দিনে সেই ফাঁকগুলো পূরণ করা যায় কি না।’
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে হামাস ব্লিঙ্কেনকে ইসরাইলের ওপর ‘সরাসরি চাপ’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

হামাস বলেছে, ‘তিনি ইসরাইলের সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের চুক্তির বিষয়ে কথা বলে চলেছেন কিন্তু আমরা কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে কথা বলতে শুনিনি।’

রক্তক্ষয়ী গাজা যুদ্ধ এখন নবম মাসে চলে আসছে, লেবাননের সাথে ইসরাইলের উত্তর সীমান্তে মারাত্মক সহিংসতা তীব্র হয়েছে।

লেবাননের একটি সামরিক সূত্র বলেছে, মঙ্গলবার একটি ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর এক কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন গুলি বিনিময় হচ্ছে। বুধবার, হিজবুল্লাহ প্রায় ১৫০টি রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্রের তিনটি ঢেউ উত্তর ইসরাইলের দিকে আছড়ে পড়ে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, এতে আগুনের খবর পাওয়া গেছে কিন্তু কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

হিজবুল্লাহ ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উপর একটি ড্রোন হামলাসহ আরও ১০টিরও বেশি হামলার দাবি করেছে।
হিজবুল্লাহর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাশেম সাফিউদ্দীন ‘তাদের আক্রমণের তীব্রতা, শক্তি,পরিমাণ এবং গুণমান বৃদ্ধি’ করার হুমকি দিয়েছেন।

নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনী ‘উত্তরের নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার’ করতে ‘খুব তীব্র অভিযানের জন্য প্রস্তুত’।

দোহায়, ব্লিঙ্কেন বলেছেন, হিজবুল্লাহ-ইসরাইল সহিংসতা বন্ধে সহায়তা করার ‘সর্বোত্তম উপায়’ ছিল ‘গাজার সংঘাতের সমাধান এবং একটি যুদ্ধবিরতি’।
হামাস-শাসিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক হামলায় এ পর্যন্ত গাজায় কমপক্ষে ৩৭,২০২ জন নিহত হয়েছে। যাদের বেশিভাগই নারী ও শিশু এবং বেসামরিক নাগরিক।

মধ্য গাজার বুরেজ শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা আহমেদ আল-রুবি বলেছেন, তিনি আশা করেন একটি চুক্তি ‘আমরা যে মারাত্মক দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি’ তার অবসান ঘটাবে।
তিনি এএফপি’কে বলেন, ‘আমি একটি যুদ্ধবিরতির আশা করছি।’

বাইডেনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে ইসরাইলি প্রচারাভিযান গ্রুপ হোস্টেজ অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলি ফোরাম বলেছে, হামাসের প্রতিক্রিয়া ‘ইসরাইলের পণবন্দী চুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করার দিকে আরেকটি পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে’।

সংস্থাটি ইসরাইলকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচকদের পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে সতর্ক করে বলেছে, ‘যেকোন বিলম্ব একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে বিপন্ন করতে পারে’।

কিছু গাজাবাসীও হামাসকে একটি চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আরও কিছু করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গাজার অভ্যন্তরে তার বোমাবর্ষণ এবং স্থল অভিযান অব্যাহত রেখেছে। যেখানে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহতে ‘বিমান ও আর্টিলারি গোলাবর্ষণ’ করা হয়েছে।

আল-নাসের হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, রাফাহতে বাড়ি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বোমা হামলায় একটি শিশু নিহত হয়েছে। খান ইউনিসের কাছাকাছি বিমান হামলা ও কামানের গোলা আঘাত হেনেছে।
আরো উত্তরে, সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি গাজা শহরের জেইতুন ও আশেপাশের একটি বাড়িতে হামলায় কমপক্ষে চারজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে। যেখানে একটি হাসপাতাল আগে বলেছে, ভোরের আগে একটি অভিযানে সাতজন নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘের একটি তদন্ত বুধবার এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে, গাজা যুদ্ধের সময় ইসরাইল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের চেষ্টা’।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিশন উল্লেখ করেছে ‘গাজার বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ব্যাপক বা পদ্ধতিগত আক্রমণ’ যার মধ্যে ‘যুদ্ধের একটি পদ্ধতি হিসাবে অনাহারে মৃত্যুর’ চেষ্টা রয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যুদ্ধের এই মাসগুলোতে ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে একটি অনন্য স্তরের ধ্বংস এবং এক অনন্য মাত্রার হতাহতের ঘটনা দেখেছে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গাজায় তীব্র অপুষ্টির জন্য পাঁচ বছরের কম বয়সী আট হাজারটিরও বেশি শিশুকে চিকিৎসা করা হয়েছে। যেখানে গুরুতর অপুষ্টিতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য শুধুমাত্র দুটি কেন্দ্র বর্তমানে চালু আছে।

সূত্র : আল জাজিরা এবং এএফপি

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ