স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। আজ (সোমবার) দুপুরে সংঘটিত এই দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। চীনের নির্মিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই মডেলের এই যুদ্ধবিমান রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় স্কুল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিল।
এই দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। জানা গেছে, বিমানটি দুপুর ১টার দিকে একটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ মিশনে আকাশে উড়েছিল। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলের মূল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, বিমানটি আসলে কী ধরনের এবং এর কার্যকারিতা কতটা নিরাপদ।
এ বিষয়ে জানা গেছে, এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের তৈরি একটি উন্নত যুদ্ধবিমান। এটি মূলত ওই নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের জে-৭জি মডেলের উন্নত সংস্করণ। এটি বিশেষভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ীই ডিজাইন করা হয়েছিল এবং ২০১৩ সালে বাংলাদেশে সরবরাহ করা হয়। এটি প্রধানত ইন্টারসেপ্টর হিসেবে বা প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় এবং কাছাকাছি দূরত্বের আকাশযুদ্ধে এর পারদর্শিতা রয়েছে।
ভারতীয় ফার্স্টপোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এফ-৭ বিজিআই’ মডেলটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক। এতে রয়েছে ‘কেএলজে-৬ এফ’ নামক উন্নত ফায়ার কন্ট্রোল রাডার, যার সাহায্যে এটি ৮৬ কিলোমিটার দূর থেকে শত্রুকে শনাক্ত করতে পারে। পাশাপাশি এটি একসঙ্গে ছয়টি লক্ষ্য ট্র্যাক করতে পারে এবং দুটি লক্ষ্যবস্তুতে একযোগে আক্রমণ করতে পারে। বিমানটির ককপিট পুরোপুরি ডিজিটাল। ককপিটে রয়েছে তিনটি মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে ও হেড-আপ ডিসপ্লে, যা পাইলটের অবস্থা অনুধাবনে সহায়তা করে।
‘এফ-৭ বিজিআই’-এর সর্বোচ্চ গতি ‘মাক ২.২ ’। এর মানে হলো, বিমানটি শব্দের গতির চেয়ে ২.২ গুণ বেশি দ্রুত উড়তে পারে। এ হিসাবে এই বিমান সর্বোচ্চ প্রায় ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে উড়তে পারে, যা যাত্রীবাহী বিমানগুলোর তুলনায় অনেক অনেক বেশি দ্রুত। এ ছাড়া এই বিমান ৫৭ হাজার ৪২০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম।
বিমানটির আফটারবার্নিং ইঞ্জিন বা অতিরিক্ত জ্বালানি ছড়িয়ে ৮২ কিলোনিউটন শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব। এতে রয়েছে পাঁচটি হার্ড পয়েন্ট, যার মাধ্যমে এটি পিএল-৫, পিএল-৭ ও সম্ভবত পিএল-৯ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। এ ছাড়া এটি প্রায় ১ হাজার ৩৬০ কেজির বোমা ও রকেট ক্যারিজও বহনে সক্ষম। তবে এর একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এটি বিভিআর মিসাইল বহনে সক্ষম নয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে এটি মিসাইল দিয়ে আঘাত হানতে পারে না।
ডাবল-ডেল্টা উইং ডিজাইনের কারণে এটি অন্যান্য অনেক মিগ বা যুদ্ধবিমানের তুলনায় বেশি ম্যানুভারেবল বা চটপটে। এটি অ্যান্টি-শিপ মিশনের জন্য সি-৭০৪ মিসাইলও বহন করতে পারে এবং হেলমেট-মাউন্টেড লক্ষ্যনির্ধারক ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত টার্গেট শনাক্ত করতে পারে।
তবে বিভিন্ন দেশে এই মডেলের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা বিমানটির নিরাপত্তা ও টেকনিক্যাল নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। গত মাসে মিয়ানমারে একটি জে-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে চারজনের মৃত্যু ঘটে। মিয়ানমার সরকার দুর্ঘটনাটিকে ‘কারিগরি ত্রুটি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও সশস্ত্র বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা বিমানটি ভূপাতিত করেছে। ২০২২ সালে চীনের শিয়াংইয়াং শহরেও একটি জে-৭ আবাসিক ভবনে পড়ে যায়। তবে সেই যাত্রায় পাইলট প্যারাস্যুট ব্যবহার করে বেঁচে যান।
এসব দুর্ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুতর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে চীনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের গুণমান। বাংলাদেশের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও সেই প্রশ্নগুলোকে আরও তীব্র করে তুলবে।