ব্যাংক খাতে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। গত ১৮ বছরে এ ঋণ অবলোপন করা হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে নতুন করে অবলোপন করা হয়েছে ৯৭৪ কোটি টাকা। এ সময় পুরোনো এবং নতুন অবলোপন থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৪৭২ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাবের খাতা পরিষ্কার দেখাতে এ পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। এতে সাময়িক খেলাপি ঋণ কম দেখালেও প্রকৃত খেলাপি ঠিকই বাড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কারপেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। সে কারণে খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে মাত্র এক লাখ কোটি টাকা। অথচ সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এসব টাকা ফেরত আনতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিকল্প নেই। ঋণখেলাপিদের জেলে ঢুকিয়ে সম্পত্তি ক্রোক করে কিছু টাকা আদায় করা যেতে পারে। অন্য কোনো উপায়ে টাকা ফেরত আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৯৭৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের বর্তমান যে পরিমাণ খেলাপি রয়েছে তার ৫৭.৩১ শতাংশ। এ সময়ে অবলোপন স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬০৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ৪১ ব্যাংকের ২৪ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বিদেশি ৯ ব্যাংকের ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ৩ ব্যাংকের ৩৬৫ কোটি টাকা। বছরভিত্তিক আদায়ের চিত্রে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ৪৭১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। আগের বছর ২০২০ সালের একই সময়ে আদায় ৭৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের একই সময়ে আদায় করা হয়েছে ৮৩১ কোটি ২১ লাখ টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপির নানা শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। যদিও প্রথমে পাঁচ বছরের বেশি ঋণ অবলোপন করা যেত, এখন তা তিন বছর হলেই অবলোপন করা যায়। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম, সেই ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে এ ঋণ পুনঃতফশিল বা পুনর্গঠন করা যায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। আর এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।
গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। যদিও কোভিডের কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় কয়েক দফায় সুযোগ দেওয়া হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। তাই এ ধরনের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকায় ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখাতে কৌশলেই মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করার পথে হাঁটছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ আদায়ে সব ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হলে তখন অবলোপনের পথে হাঁটে ব্যাংকগুলো। তবে এ টাকা আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় অর্থঋণ আদালতের নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণেও ঋণ আদায়ের গতি শ্লথ হয়ে যায়।