শিক্ষার্থীদের তুমুল বিক্ষোভের মুখে প্রাথমিকভাবে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী ২০ অক্টোবর হতে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়। দলবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগ দাবিতে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে যোগ দেয় জাতীয় নাগরিক কমিটিও। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে একে একে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে দোয়েল চত্বরে জড়ো হয়ে হাইকোর্টের উদ্দেশে রওনা দেন তারা। সোয়া ১২ টার দিকে হাইকোর্টে প্রবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। যদিও এর আগে পৌনে ১২টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামান্য বাধা উপেক্ষা করে হাইকোর্টের প্রবেশ করে অবস্থান নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দক্ষিণ গেট দিয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন। সঙ্গে ছিলেন আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম। একই সঙ্গে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ।
গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ফারুক খান এবং ড. আব্দুর রাজ্জাকের রিমান্ড আবেদন শুনানির সময় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএ) আদালতের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা। উক্ত ঘটনায় জড়িত আইনজীবীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘বিচারালয়ে খুনি হাসিনার পুনর্বাসনে মঙ্গলবার মিছিল বের করা হয়েছে। তাদেরকে অপসারণে সুপ্রিম কোর্ট-হাইকোর্টের কোনো ধরনের এখতিয়ার নেই। আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দাবি জানাই, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভিডিও ফুটেজ ধরে ধরে তাদেরকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করুন। সেই সঙ্গে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সমন্বয়ক।
আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, রোববারের মধ্যে যদি প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত না আসে সোমবার নতুন কিছু এ বাংলাদেশ দেখবে। কখন, কার বিরুদ্ধে কেমন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা এ বাংলার ছাত্র-সমাজ জানে। সচিবালয় থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো জায়গায় স্বৈরাচারের দোসরদের ঠাঁই হবে না।
এ সময় শিক্ষার্থীরা সেøাগান দেন ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ,’ ‘স্বৈরাচারের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান,’ ‘ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে, হাইকোর্ট ঘেরাও হবে,’ ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ,’ ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা,’ ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম,’ ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’ ইত্যাদি সেøাগান দেন। এ ছাড়া তারা শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে সেøাগান দেন। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে উচ্চ আদালতের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এই কর্মসূচি চলাকালে বেশ কয়েকজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো: আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো: আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলন।
বেলা ৩টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সম্পাদক মাহবুবুর রহমান খান। আলোচনা শেষে বিকেল ৪টার দিকে হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভস্থলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ঘোষণা দেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। তার এ ঘোষণার পর বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা চেড়ে চলে যান।
যা বললেন রেজিস্ট্রার জেনারেল: শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা শেষে আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, আমি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল হিসেবে আপনাদের দাবি নিয়ে আপনাদের যারা লিডার তাদের সঙ্গে আমার চেম্বারে বসে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। আপনারা জানেন, বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একটা সংশোধনী হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সরকার সেটা রিভিউ আকারে পেশ করেছে। আগামী রোববার সেটা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগে শুনানি হবে। এক নম্বর আইটেমে রাখা হয়েছে সেটি।
বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, বিচারপতিদের নিয়োগ কর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণ; সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে হয়ে থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেয়ার অর্থ হলো, আগামী ২০ অক্টোবর তারিখ যে কোর্ট খুলবে, তারা বিচার কাজে অংশ নিতে পারবেন না। এই মামলাটার শুনানি আছে ওই দিন। অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি প্লেস করবেন বলে আশা করছি। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে। আর বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে এককভাবে সুপ্রিম কোর্ট জড়িত না। রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাও জড়িত আছেন। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।
পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বিচারপতি অপসারণের সংশোধনী নিয়ে মামলাটি চলমান। আগামী ২০ তারিখ ওই মামলায় যদি সমাধান চলে আসে, তাহলে বিচারপতি অপসারণের দায়িত্ব হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। তাহলে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে হবে অথবা অপসারণ করা হবে। এখন রোববার বিকেল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। আমরা অবজার্ভ করবো তাদের অপসারণের জন্য কী রায় আসে। তারপর ঠিক করা হবে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।
হাইকোর্টের যে ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হলো : দুর্নীতি ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ওঠায় যে ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তারা হলেন- বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো: আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি মো: আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান।