শুরু হলো ভাষার মাস

(মালিক মনজুর, বিশেষ প্রতিনিধি, ইতালি): ভাষার মাস শুরু। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি-ভাষা আন্দোলন দিবস যা রাষ্ট্রভাষা দিবস বা শহীদ দিবস নামেও পরিচিত আমাদের সবার কাছে। বাংলাদেশে পালিত হয় একটি জাতীয় দিবস হিসেবে। দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার লক্ষ্যে যারা শহীদ হয় তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য এই জাতীয় দিবসটি পালন করা হয় প্রতি বছর।১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি পালন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ যদি এক অবিভক্ত রাষ্ট্ররূপে স্বাধীনতা লাভ করত, তাহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলাই সম্ভবপর হতো না। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মহাত্মা গান্ধী প্রশ্ন করেছিলেন, যদি ভারত স্বরাজ লাভ করে, তবে এদেশের সাধারণ ভাষা কী হবে? জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, হিন্দী।

রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ভারতবর্ষের তিনটি ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। ভাষা তিনটি হলো – বাংলা, উর্দু এবং হিন্দী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য যে অত্যন্ত বাস্তব সম্মত ছিল তা এখন প্রমাণিত। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের রাষ্ট্রভাষা যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পৌনে দু’শ বছরের বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে অবিভক্ত নয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসাবে। একটি ভারত, আরেকটি পাকিস্তান। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অখন্ড। অপর পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে। হাজার মাইলেরও অধিক দূরত্বে অবস্থিত দু’টি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।সাধারণ ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বিবেচনায় আনা হয়নি।

বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ হিসাবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস এবং হরতালের ডাক দেয়। এর পরের ঘটনা সবারই জানা আছে । রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।এটা আমাদের বাংগালী জাতির গৌরব।।
দেশভাগের পর থেকে ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত বাঙালীরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন।

প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলেছে। তবে এই আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় যখন বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ’র কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সে সময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।

তবে এই ঘটনার পরও দুই বছরের বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর। মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ