রোববার সকাল ১১টা। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে উপচে পড়া ভিড়। সেবাপ্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপের সঙ্গে দলিল লেখকদের হাঁকডাক। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই কারও। মূল ভবনে ঢুকতেই নিচতলার বামদিকে সূত্রাপুর অফিস। তখন সাবরেজিস্ট্রার আজমল হোসেনের নামফলকের সামনে দাঁড়িয়ে ৪-৫ জনের শলাপরামর্শ চলছে। এ সময় নকলখানা থেকে বের হয়ে এলেন একজন। দ্রুত তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে একজন বলেন, ‘মাসুদ ভাই এটা রাখেন। বিশ হাজার দিলাম। বাকিটা পাবেন কাল। কাজটা করে দেন।’ মাসুদ বলেন, ‘কাল সম্ভব না। পরশু হয়ে যাবে।’
প্রকাশ্যে ঘুস লেনদেনের এমন চিত্র রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের সর্বত্র। এ যেন ঘুসের স্বর্গরাজ্য। কোনো রাখঢাক নেই। ঘাটে ঘাটে বাঁধা ঘুসের রেট। মুখে মুখে ঘুরছে ফর্দ। ঘুসের কারবার চলছে অনেকটা সাধারণ ব্যাংকিংয়ের মতো। দিনশেষে ঘুসের টাকা বণ্টনে চালু আছে অটোপদ্ধতি। অর্থাৎ নির্বিঘ্নে নির্ধারিত কমিশন পৌঁছে যায় সংশ্লিষ্টদের টেবিলে।
বাধ্যতামূলক নজরানা : রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখকদের মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের ঘুস আদায়ের রেওয়াজ বহুদিনের। নাম ‘অফিস খরচ’ বা ‘নজরানা’। জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি করতে গেলে বর্ণনা শুনে নির্ধারিত সরকারি ফির পরিমাণ বলে দেন দলিল লেখক। এরপরই আসে নজরানার হিসাব। দলিল মূল্যের দশমিক দুই শতাংশ হারে অফিস খরচ না দিলে জমি রেজিস্ট্রি একেবারে অসম্ভব।
সূত্র বলছে, তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে গড়ে প্রতিদিন ৫শ দলিল রেজিস্ট্রি হয়। সে হিসাবে দৈনিক আদায়কৃত ঘুসের অঙ্ক কমপক্ষে ২৫ লাখ। মাসের ২০ কর্মদিবসে আদায় হয় পাঁচ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের ঘুসে চলে পুরো নেটওয়ার্ক। ঘুসের শতকরা ৭০ শতাংশ চলে যায় কতিপয় অসাধু সাবরেজিস্ট্রারের পকেটে। এছাড়া টাকার ভাগ পান অফিস সহকারী, মোহরার, এক্সট্রা মোহরার বা নকলনবিশ এবং পিয়ন। কতিপয় উমেদারের ওপর পুরো নেটওয়ার্কের ঘুস আদায় এবং বণ্টনের দায়িত্ব অর্পিত। অবশ্য এর বাইরে বড় বড় কিছু বিশেষ জমি রেজিস্ট্রির বিষয় থাকে। যেখানে থাকে বড় ধরনের ফাঁক। করা হয় জালজালিয়াতি। ভুয়া নামজারিসহ প্রয়োজনীয় আরও কিছু জাল কাগজপত্র সৃষ্টি করে জমি রেজিস্ট্রি হয়। এসব জমি রেজিস্ট্রি হওয়ার পর ওই দলিল দিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে সমাজের প্রভাবশালীদের বিশেষ হাত থাকে।
সরেজমিন দেখা যায়, জমির শ্রেণি পরিবর্তন নিষিদ্ধ হলেও ঘুস দিলে কোনো কিছু ‘অসম্ভব নয়’। বড় অঙ্কের ঘুস পেলে নাল জমিকে ভিটি, ভিটি জমি মুহূর্তেই বাড়িতে রূপান্তর হয়ে যায়। এছাড়া ওয়ারিশ নির্ধারণসংক্রান্ত জটিলতায় ঘুস লেনদেন অবধারিত। দলিলের নকল, ভোটার আইডি জটিলতা ইত্যাদি কাজে ঘুস বাণিজ্য বেশুমার। এছাড়া জমি রেজিস্ট্রিতে স্থানীয় কর, উৎসে কর, ৫৩/এইচ এবং ৫৩/এফএফ নিয়ে অস্পষ্টতার সুযোগে দুর্নীতি চলছে মহাসমারোহে। আবার পে-অর্ডার নিয়ে সরকারি গেজেটেও রয়েছে ধোঁয়াশা। কোন দলিলে উৎসে কর দিতে হবে, কোটায় দিতে হবে-না কীভাবে দিতে হবে তা জানে না অনেকেই। এর সুযোগ নিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা।
ঘুসের বিনিময়ে রেকর্ড রুমে ভূতুড়ে ঘটনার নজির ভূরি ভূরি। অসাধু চক্রের যোগসাজশে রাতের আঁধারে ভলিউমে ঘষামাজা করা হয়। এরপর ঘাটে ঘাটে চলে টাকার খেলা। এছাড়া দলিলে দাগ ফেলা বা পাতা হারানোর ঘটনা তো অহরহ। এমনকি বড় অঙ্কের লেনদেন হলে পুরো ভলিউম গায়েব করে ফেলা হয়। আবার হাতে লিখতে গিয়ে কারও নাম বা পিতার নামের অক্ষরে এদিক-সেদিক হয়ে গেলে বড় বিপদ। দুর্নীতিবাজদের পোয়াবারো। এমন ভুলের খেসারত দিতে হয় মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রেজিস্ট্রি অফিসে বকশিশ বা শুভ কাজের মিষ্টি খাওয়ানোর খরচ কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা। এর ওপরে যে যা নিতে পারে। রেজিস্ট্রির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুসের লম্বা ফর্দ শোনা যায় দালাল-কর্মচারীদের মুখে মুখে। যেমন রেজিস্ট্রির পর দলিলে টিপসই দেওয়া হলেই তাৎক্ষণিক একশ টাকা দেওয়া দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। তাই আঙুলের ছাপ নেওয়ার পরপরই টাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মচারী। এমনকি দলিলের বান্ডিল সেলাইয়ে আছে বিশেষ বকশিশ। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে পে-অর্ডার করতে বকশিশের নামে ঘুস আদায়ের রেওয়াজ সম্প্রতি চালু হয়েছে।
রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের বিভিন্ন অফিস ঘুরে ঘুস লেনদেনের অবিশ্বাস্য চিত্র ধরা পড়ে গোপন ক্যামেরায়। মোহাম্মদপুর অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সাবরেজিস্ট্রারের চেয়ার খালি। কিন্তু এজলাসের পাশেই চেয়ার-টেবিলে বসে ফাইলপত্রে সই-স্বাক্ষর করছেন একজন। তার এক হাতে কলম, অন্য হাতে মোবাইল কানে ধরে কথা বলছেন অনর্গল। দূর থেকেও তার কথাবার্তার দু-একটি শব্দ শোনা যায়। তিনি কাকে যেন বলছেন, জি জি, আপনার কাজটা একটু জটিল, তবে দেখি, হয়ে যাবে, চিন্তা কইরেন না।
অফিসের কর্মচারীদের কাছে জানা গেল তার পরিচয়। নাম উমেদার আব্দুস সোবহান। রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন তিনি। অফিসের সবাই জানেন ‘সোবহান সাহেব’ ধনাঢ্য লোক। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে বাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন বহু আগে। তার একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ির খবরও পুরোনো। অনেকেই বলেন, ‘সাবরেজিস্ট্রার আসে-যায়। কিন্তু মোহাম্মদপুর অফিস চলে সোবহানের ইশারায়।’ কারণ দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি একই জায়গায় কর্মরত। মোহাম্মদপুর অফিস থেকে তাকে বদলির কথা কেউ চিন্তাও করে না। বরং তার ভয়ে তটস্থ থাকেন সাবরেজিস্ট্রারদের অনেকে।
দোতলায় উঠতেই বাড্ডা সাবরেজিস্ট্রারের কক্ষের সামনে বারান্দায় ৩-৪ জনের উত্তেজিত কথাবার্তা কানে আসে। দেখা যায়, একজনের হাতে এক লাখ টাকার দুটি বান্ডিল। টাকা লেনদেন ঘিরেই তর্কের সূত্রপাত। উত্তেজিত একজন বলছেন, ‘ধুর মিয়া, এই কয়টা ট্যাকা দিয়া অবিশ্বাস করতাছেন। যান আপনার কাজ হইব না। তিনি অফিসের ভেতরে ঢুকেই যাচ্ছিলেন। এ সময় পাশ থেকে দুজন এগিয়ে এসে তাকে শান্ত করেন।’
বেলা তখন ২টা বেজে ১০ মিনিট। তৃতীয়তলার রেকর্ড রুমের সামনে ভিড়ের চাপ। ভিড় ঠেলে অজ্ঞাত এক মধ্যবয়সি নারী চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন। তিনি বলছেন, ‘এরা কী ট্যাকা লইয়া কবরে যাইব। এত ক্ষুধা ক্যান। সামান্য কাজে এত ট্যাক্যা চায়।’ কে টাকা চেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপরে যান সব দেখতে পাবেন।’
রেকর্ড রুমের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দালাল, নকলনবিশ ও উমেদারদের জটলা। যাদের একজন বলছেন, ‘দলিলের নকল লাগব না। একবার শুধু ভলিউমে নজর বুলামু। কয় ট্যাকা লাগব কন।’ রেকর্ড রুমের এক কর্মচারী বলেন, ২ হাজার দিবেন।’ সেবাপ্রার্থী বলেন, ‘আপনেরা ট্যাকা কামাইতাছেন কামান। তাই বইল্ল্যা কি জবাই করবেন।’ তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ২ হাজারেই রাজি হলেন। টাকা লেনদেন শেষে তিনি নিচে নেমে গেলেন।
রেকর্ড রুমে সাঁতার : তৃতীয় এবং চতুর্থতলায় রেকর্ডরুমের অভ্যন্তরে উঁকি দিয়ে যা দেখা যায় তা এই বর্ণনায় বোঝানো কঠিন। বিশালাকারের অসংখ্য সেলফ। তাতে ছড়ানো ছিটানো ভলিউম বুক ধুলোয় ঢাকা। বেশিরভাগই ছেঁড়াফাটা। অঢেল কাগজের স্তূপ যেন খসে খসে পড়ছে। এর মাঝেই অনেকটা সাঁতার কেটে পুরোনো ভলিউম খুঁজে আনার কাজ চলছে।
ভেতরের কর্মচারীদের একেকজনের নাম ধরে হাঁক দিলে তিনি বেরিয়ে আসছেন। কেউ ডাকছেন গৌতম দা, কেউ বলছেন মহিউদ্দিন ভাই, শের আলী মামা ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পরপর ৪-৫টি ভলিউমের বোঝা একসঙ্গে ঘাড়ে চাপিয়ে বের হচ্ছেন ২-১ জন। ভলিউম তল্লাশির কাজে নিয়োজিত উমেদার, তল্লাশিকারক এবং দালালদের দম ফেলার ফুরসত নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেকর্ড রুমে ভলিউম যাচাই বা নকল তুলতে ঘুস লেনদেন ওপেন সিক্রেট। সরকারি ফি যৎসামান্য হলেও নকলের সর্বনিম্ন ঘুস চার হাজার। এর ওপরে যে যা নিতে পারে। এর মধ্যে ২৭০ টাকা আদায় করা হয় সেরেস্তা ফি হিসাবে। এ টাকার পুরোটাই ঘুস। যার ভাগ চলে যায় নকলনবিশ ও তল্লাশিকারকদের পকেটে। অথচ অনেকেই জানেন ‘সেরেস্তা ফি’ হলো সরকারি রাজস্ব।
উমেদারনামা : সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রেজিস্ট্রি অফিসের ঘুস চ্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অসাধু ‘উমেদার’ সিন্ডিকেট। সাবরেজিস্ট্রারের খাস কামরায় তাদের অবাধ যাতায়াত। রেকর্ডরুমসহ মূল্যবান দলিল-দস্তাবেজও তাদের কব্জায়। এ কারণে উমেদারদের অনেকেই প্রভাবশালী। এমনকি তাদের অনেকে হাত মিলিয়েছেন দলীয় রাজনীতি এবং স্থানীয় সিন্ডিকেটের সঙ্গে।
রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের প্রভাবশালীদের উমেদারদের অন্যতম হলেন-মোহাম্মপুর অফিসের বাবু হাওলাদার। তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। বাড়ি করেছেন বাড্ডায়। বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বাবুকে প্রায় প্রতি রাতেই দেখা যায় গুলশানের একটি পাঁচতারকা হোটেলের বারে। তিনি হত্যা মামলারও আসামি। জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। তবে অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে তাকে অন্যত্র সরানো কঠিন। এছাড়া রেকর্ড রুমের উমেদার ওয়াজিদ, গৌতম, শের আলী, শহীদ-১, শহীদ-২, আব্দুল মালেক, ইসমাইল হোসেন ও হায়াতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ভূরি ভূরি। ঢাকা সদর অফিসের লোকমান এবং খিলগাঁওয়ের সাহিনের নাম আছে ধনাঢ্য উমেদারের তালিকায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন উমেদারকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। যেমন-পল্লবীর সাবেক উমেদার জসিমের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়লে তাকে সাভারে বদলি করা হয়। কিন্তু ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি নন জসিম। বর্তমানে তিনি রাজিব নামের এক আত্মীয়কে দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন পল্লবী অফিস। এছাড়া সম্প্রতি বদলিকৃত উত্তরা অফিসের উমেদার মহিউদ্দিন, ধানমন্ডির আসিক, রানা, জাকির এবং সাদ্দাম ফের ঢাকায় ফেরার জন্য তৎপর।
জানা যায়, উমেদারদের অনেকে কোটিপতি বনে গেলেও তারা কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে। হাজিরা মজুরি নির্ধারিত ৬০ টাকা। খাতা-কলমে ঢাকা জেলায় উমেদারের সংখ্যা ৯৯ জন। কিন্তু বাস্তবে রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে উমেদার আছেন কয়েকশ। তাদের অনেকে আবার নিয়োগ দিয়েছেন একাধিক সহকারী। জমির দালালরা মূলত উমেদারদের সহকারী হিসেবে পরিচিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উমেদার ছাড়াও বেশ কয়েকজন কেরানি বেপরোয়া। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাড্ডা অফিসের কেরানি রাসেল। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এ কারণে তিনি কথায় কথায় এক মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চলেন। অন্যত্র পোস্টিং করা হলেও ঘুরেফিরে তিনি ফের বাড্ডা অফিসে হাজির হন। এছাড়া এক মন্ত্রীর এপিএসের আপন ছোট ভাই পরিচয়ে বেপরোয়া পল্লবীর কেরানি সামিউল।
রেজিস্ট্রি অফিসের নকলনবিশদের বিরুদ্ধেও ঘুস বাণিজ্য এবং দালালির অভিযোগ ভূরি ভূরি। বিশেষ করে বাড্ডার সেলিম, ঢাকা সদরের সাহিন, গুলশানের নজরুল ইসলাম, খিলগাঁওয়ের রাসেল, পল্লবীর শামিম, উত্তরার মহিউদ্দিন ও সাগর, ধানমন্ডির তরিকুল এবং রেকর্ড রুমের সারোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সূত্র বলছে, নকলনবিশরা ভলিউম লিখলে টাকা পান। নির্ধারিত মজুরি ২৪ টাকা। কিন্তু অনেকে বছরের পর বছর এক পাতা না লিখেও টিকে আছেন। অনেকে আবার সমিতির রাজনীতিতে জড়িয়ে এখন প্রভাবশালী। কেউ কেউ আসল পরিচয় লুকিয়ে নেতা পরিচয় দিতেই আরাম বোধ করেন। ভলিউম না লেখায় বাড্ডার নকলনবিশ সেলিমের বিরুদ্ধে শোকজের হাফ সেঞ্চুরি হয়েছে। কিন্তু এতে তার কিচ্ছু আসে যায় না।
নকলনবিশ ছাড়াও বেশ কয়েকজন মোহরার এবং টিসি মোহরারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। এদের মধ্যে মোহাম্মদপুরের সাবেক মোহরার জয়নালের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। এছাড়া উত্তরা অফিসের সাবেক মোহরার শহীদ ওরফে নেতা শহীদ, মোহাম্মদপুরের সাবেক মোহরার হেলেনা এবং গুলশানের এক্সট্রা মোহরার সোহাগ এবং তার এক ভাই, বাড্ডা অফিসের টিসি মোহরার সৈয়দ বায়েজিদ এবং মোহাম্মদপুরের মুকুলের বিরুদ্ধেও ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ ভূরি ভূরি।
হেভিওয়েট দুর্নীতিবাজ : রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের কয়েকজন সাবরেজিস্ট্রার হেভিওয়েট দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে বাড্ডার সাবরেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। সাভারে কর্মরত থাকার সময় বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগে তিনি বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই তার কর্মজীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এছাড়া গুলশান থেকে বদলি হওয়া বিএনপিপন্থি সাবেক এক সাবরেজিস্ট্রার নাকি শতকোটি টাকার মালিক। খিলগাঁওয়ের সাবেক সাবরেজিস্ট্রার কাওসার আহমেদ এবং ঢাকা সদর থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া সাবরেজিস্ট্রার শাহ আলমের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের অবৈধ টাকার গন্ধে মাতোয়ারা স্থানীয় মাস্তানদের অনেকে। জনৈক নেতা নুর হোসেন ওরফে লেদু এবং এক ওয়ার্ড কমিশনারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের নামে চাঁদা ওঠে প্রতিদিন। এছাড়া লেদুর ভাগিনা খিলগাঁও অফিসের নকলনবিশ রাসেল, পল্লবী অফিসের দলিল লেখক সাকিল ও রেমন কথায় কথায় ক্ষমতার ছড়ি ঘোরান। রেজিস্ট্রি অফিসে ছোটখাটো গোলমাল বাধলে মীমাংসার জন্য তাদেরই ডাক পড়ে।
তবে রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সের অনিয়ম-দুর্নীতি এখন অনেক কম বলে দাবি করেন ঢাকা জেলার নিবন্ধক (ডিআর) সাবিকুন নাহার। ৭ মার্চ তিনি তার কার্যালয়ে বলেন, ‘দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। এর ফলে অনেকের মধ্যে সেবার মনোভাব ফিরে এসেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজের স্বচ্ছতা এবং হয়রানি বন্ধে তিনি ১শ দিনের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেন। এতে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া সেবাপ্রার্থীদের জন্য তার অফিস সব সময় খোলা। অহেতুক ভোগান্তি বা হয়রানির শিকার হলে সরাসরি অথবা ফোনে যে কেউ তার কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন।’ সূত্রঃ যুগান্তর