রাজনীতি ছাপিয়ে আবার আলোচনায় ভিসা নীতি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরুর পর দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। ভিসা নীতির আলোচনায় চাঙ্গা এখন রাজনীতির মাঠ। অন্যসব ইস্যু ছাপিয়ে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশের এমন পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কে মেতে আছে বড় দুই দল। টেলিভিশন টকশোতেও এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি আলোচনা। সর্বশেষ গণমাধ্যম কর্মীরাও ভিসা নীতির আওতায় আসতে পারেন—মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যের পর আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। শহরের অলিগলি থেকে গ্রামগঞ্জে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানেও চলছে ভিসা নীতির আলোচনা। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রে ভিসা নীতি। আবার কেউ কেউ এক কাঠি এগিয়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ব্যক্তিদের তালিকাও প্রচার করছেন নিজেদের মতো করে। একেকজনের তালিকায় থাকছে আলাদা নাম ও সংখ্যা। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আনুষ্ঠানিক ঘোষাণা ছাড়া ‘ভিত্তিহীন’ এসব তালিকায় গুরুত্ব না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত এবং সমর্থন করতে গত ২৪ মে নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন থেকেই এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। গত শুক্রবার ভিসা নীতি কার্যকরের আকস্মিক ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিবিদরা, যা সাধারণ মানুষের আলোচনায় নানা মাত্রা যোগ করছে।

ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরুর ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণায় তীব্র হতাশা বোধ করছি। সেলফি তুলে কী আনন্দে ছিলেন তারা। তাদেরই আমেরিকা থাকার সময় এই অবমাননাকর ঘোষণা পুরোই ছোটলোকী! আর বিরোধী দলের ওপরও ভিসা নীতি প্রয়োগ হচ্ছে, এটা কী ধরনের কথা! বিরোধী দল শুধু বিএনপি, এটা বলতে হবে। না হলে রওশন এরশাদ, মেনন-ইনুগণ যদি ভয় পান, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কীভাবে?’

এদিকে মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উদ্বিগ্ন নয় বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন, ভিসা নীতির ফলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে সহিংসতা চালালে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়বে।

আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেছেন, ‘মার্কিন ভিসা নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। এটি এ বছরের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল। এ ভিসা নীতি তারা প্রয়োগ শুরু করেছে। এ ভিসা নীতি বিরোধী দলের ওপরও প্রযোজ্য। শুধু তা-ই নয়, এই নীতির ফলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়ছে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী। মার্কিন ভিসা নীতির প্রয়োগের ফলে কয়েকটি কারণে বিএনপির রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতির কারণে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা হবে না।’

অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এটি বাংলাদেশের জন্য চরম লজ্জাজনক। সরকারের নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় দেশ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে। বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্রের পক্ষেই পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ কালবেলাকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের একগুঁয়েমির কারণে দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘জঘন্য’ ভিসা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তিন মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিল। তাদের কাছে এখন হয়তো মনে হয়েছে যে, এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। এজন্যই তারা ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।’

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মনে করে, এ নিষেধাজ্ঞা সুষ্ঠু নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে সরকারের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, সরকারকে ভয় দেখিয়ে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন অবস্থান নিশ্চিত করতেই এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরাট বাণিজ্য সম্পর্ক, বিনিয়োগ এবং রেমিট্যান্স ঘিরে সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য দেশটি থেকে এমন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়। অভ্যন্তরীণ সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট নিরসন করা গেলে এমন নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যেত বলেও মনে করছেন তারা। তারা এ-ও বলছেন, বাইডেন প্রশাসনের একটা প্রবণতা হলো, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি অধিক জোর দেওয়া। এতে তারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয়ে সহায়তা করা তাদের সেই নীতিরই অংশ।

এদিকে ভিসা নীতি কার্যকর ঘোষণার পর থেকেই সরকারের মন্ত্রী, মেয়র, পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম ধরে ফেসবুকে বিভিন্ন ‘তথ্য’ ছড়ানো হচ্ছে। একইভাবে বিরোধী নেতাদের নামেও ছড়ানো হচ্ছে পাল্টা ‘খবর’। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ছাড়াও তাদের শরিক কয়েকটি দলের প্রধান, সরকারপন্থি প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েক নেতা, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বিচারপতিদের কেউ কেউ ভিসা নীতির আওতায় পড়েছেন বলে কয়েকদিন ধরে গুজব চলছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ হতে পারে—ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের এমন মন্তব্যের পর ভিসা নীতির আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। কোন কোন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় পড়ছেন, সেটি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে পাল্টাপাল্টি ‘ট্রল’। এমন প্রেক্ষাপটে পিটার হাসের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সোমবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নয়, বরং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নীতি কার্যকর হয়েছে।

দেশের রাজনীতিক, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি গণমাধ্যমের ওপরও এ ভিসা নীতি কার্যকর করার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে নানা কথা চলছে। কেউ কেউ নিজের আইডিতে পোস্ট দিয়ে জানতে চাচ্ছেন, তিনি এ নীতির আওতায় আসছেন কি না?

আবার কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকায় তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, সে কারণে এ ভিসা নীতি নিয়ে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। রাজনৈতিক দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরা ভিসা নীতিকে কেন্দ্র করে ‘খবর’ ছড়ানোয় ব্যস্ত হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এগুলো সবই গুজব। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি অনুযায়ী, ভিসা নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম বাইরে প্রকাশ করে না। ফলে কারও নাম এভাবে জনসমক্ষে আসার সুযোগ নেই।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি অনুযায়ী কারও ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে শুধু নির্দিষ্ট ওই ব্যক্তিকেই জানিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে কারও সঙ্গে এ তথ্য শেয়ার করে না যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কেউ পড়ে থাকলে তার পরিবারের সদস্য এবং একান্ত আপনজন ছাড়া আর কেউ জানার সুযোগ নেই। ফলে বিভিন্ন মাধ্যমে যেসব ব্যক্তির ওপর ভিসা নীতির খড়্গ পড়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে, তা আসলে গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভিসা নীতি কার্যকর ঘোষণার পর শুক্রবার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ