মুসা ছাড়া তদন্তে গতি আসছে না

রাজধানীর শাহজাহানপুরের ব্যস্ত সড়কে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার তদন্তে বেশ অগ্রগতি দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার করা হয়েছে টিপুর ওপর গুলি চালানো শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে (৩৪)।

শনাক্ত করা হয়েছে হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল। বৃহস্পতিবার রিভলভারসহ সন্ত্রাসী আরফান উল্লাহ দামালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এত অর্জনের পরেও তদন্তে প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার মুসা গ্রেফতার না হওয়ায়।

এই হত্যাকাণ্ডটি ‘কাটআউট’ সিস্টেমে হওয়ায় এক অপরাধী অন্য অপরাধীদের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য দিতে পারছে না। এতে মুসা ছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য নামগুলোর বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলেও পরিষ্কার চিত্র পাওয়া কঠিন হচ্ছে।

এদিকে টিপু হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন গ্রেফতার আরফানউল্লাহ দামালকে এক দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল গোয়েন্দা বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম বলেন, মুসাকে ধরার সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

সম্ভাব্য সবগুলো জায়গাতেই নজরদারি রয়েছে। শিগগিরই তার অবস্থানের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত মুসার অবস্থান শনাক্ত করা চেষ্টা চলছে। স্থানীয়ভাবে নজরদারির পাশাপাশি তাকে গ্রেফতারে প্রযুক্তির সহায়তাও নেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতেও তাকে শনাক্তে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দরগুলোতেও ছবিসহ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তার শরীরের গঠনের সঙ্গে মিলিয়ে মতিঝিল এলাকায় হত্যার আগে-পরের বিভিন্ন ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

যাতে করে তার সর্বশেষ অবস্থান এবং গতিপথ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মুসার ঘনিষ্ঠ এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন বিষয়ে জানেন এমন অন্তত দুই ডজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

কিন্তু কোনো পর্যায় থেকেই আশাব্যঞ্জক তথ্য পাওয়া যায়নি। টিপু হত্যার আগেই মুসা দেশ ছেড়ে ভারতে গেছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে মতিঝিল এলাকায়। গুঞ্জনে ভিত্তি দিয়েছে হত্যাকাণ্ডে আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশন এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিকের ভারতে অবস্থান।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ হত্যার তদন্তে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শুটার গ্রেফতার। সেক্ষেত্রে তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সফল হয়েছেন। কিন্তু মুসা গ্রেফতার না হওয়ায় পুরো পরিকল্পনাটি জানতে পারছেন না।

কারণ মুসাই শুটার আকাশের সঙ্গে ছয় লাখ টাকা ও মামলা থেকে বাঁচানোর আশ্বাসে হত্যাচুক্তি করে। ফলে কিলিং মিশনের আদ্যোপান্ত জানতে মুসাকে হাতে পেতে মরিয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিটের সদস্যরা।

তাকে ধরতে পারলেই টিপু হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যাবে। বেরিয়ে আসবে এর সঙ্গে আর কে বা কারা জড়িত। মুসার অবস্থান ও খুনের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বেশ কয়েকজনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এখনও গোয়েন্দাজালে আছে অন্তত ১৭ জন। এদের প্রায় সবাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়ে এদের অনেকের সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে কিছু তথ্য রয়েছে।

তবে মুসা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সহসাই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পরিকল্পনাকারী মুসাকে গ্রেফতার চেষ্টার পাশাপাশি বিকল্প উপায়গুলো নিয়েও চিন্তা করছে তদন্তকারীরা।

সেজন্য হত্যার মাসখানেক আগে কমলাপুরের রূপালী ক্লাবে (রূপালী যুব উন্নয়ন সংস্থা) চার-ছয়জনের ‘কিলিং মিশন’ চূড়ান্তের বৈঠককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন তারা। সেখানে উপস্থিত প্রতিটি সদস্যের আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করছেন।

এদের কয়েকজন এখন গোয়েন্দাজালে রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুসার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রয়েছে এমন একজনকে শিগগিরই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন গোয়েন্দারা।

এদিকে অপরাধ জগতের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পলাতক ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম দুই সহোদর প্রকাশ-বিকাশের সহযোগী হিসাবে অপরাধ জগতে পা রাখেন মুসা। দুর্ধর্ষ হওয়ায় অল্প দিনেই মুসাকে কিলার বাহিনীতে কাজে লাগায় বিকাশ।

একসময়ে পেশাদার কিলারে পরিণত হন তিনি। মিরপুরের একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি হয় মুসা। কারাগারে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুকের। ফারুক তখন অন্য একটি মামলায় জেলে ছিলেন।

এরপর জামিন হলে মুসা আর মিরপুর এলাকায় ফেরেননি। এর আগে ওমর ফারুকেরও জামিন হয়। ফলে ওমর ফারুক ও বিকাশের আরেক বন্ধু ‘রহস্যমানব’ হিসাবে পরিচিত হাসানের শেল্টারে এজিবি কলোনি এলাকায় যাতায়াত করেন।

এজিবি কলোনি ও শাহজাহানপুর এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা থেকে মাসিক হারে তোলা পেতেন মুসা। ২০১৬ সালে মুসার নেতৃত্বেই তার ভাই সালেহ, বোচা বাবুকে হত্যা করে। বাবু হত্যা মামলায় মুসা গ্রেফতারও হয়।

এরপর জামিনে বেরিয়ে মুসা চট্টগ্রাম ও ফেনী এলাকায় থাকতেন। মাঝেমধ্যে আসতেন ফকিরাপুলে। এবারও এই মুসাই মাসুম ওরফে আকাশকে টিপু হত্যায় কাজে লাগায়। নিজের ভাই সালেহকেও কাজে লাগায় হত্যাকাণ্ডে।

শাজাহানপুর ও এজিবি কলোনি এলাকায় ‘রহস্যমানব’ হিসাবে পরিচিত হাসানের নামে চলে ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা। অথচ প্রকাশ্যে তাকে কখনো এলাকায় দেখা যায় না।

এই হাসানকেও খুঁজছেন গোয়েন্দারা। হাসান এক সময় এই মতিঝিল অঞ্চলের প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ছিলেন বলে জানান স্থানীয়রা।

দামাল এক দিনের রিমান্ডে : এদিকে টিপু হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন গ্রেফতার আরফানউল্লাহ দামালকে এক দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। শুক্রবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা অস্ত্র মামলায় তার এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপপরিদর্শক মো. এরশাদ হোসেন তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিলেন। রিমান্ড আবেদনপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, অস্ত্র মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নানা তথ্য জানা যেতে পারে।

এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কমলাপুর এলাকা থেকে দামালকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তার কাছে একটি রিভলভার পাওয়া যায়। অবৈধ অস্ত্র বহন করায় মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধ পৃথক মামলা করে পুলিশ।

দামাল বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহর ভাই। এর আগে টিপু ও প্রীতি হত্যা মামলায় ২৮ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

২১ মার্চ রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় টিপুকে খুনের মিশনে অংশ নেয় পেশাদার কিলার বাহিনী। এক থেকে দেড় মিনিটের অপারেশন শেষে পালিয়ে যায় কিলাররা। ১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে টিপুর দিকে।

এর মধ্যে তার শরীরে সাত রাউন্ড গুলি লাগে। ঘটনাস্থলের আশপাশে কিলার বাহিনীর আরও কয়েক সদস্যের অবস্থান ছিল। প্রয়োজনে গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে প্রস্তুত ছিল তারা।

সুচারু পরিকল্পনায় খুব কাছ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি।

মাস্টারমাইন্ডসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব : এদিকে টিপু ও প্রীতি হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডসহ জড়িত থাকার অভিযোগে আরও চারজনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব। তবে টিপু হত্যার মাস্টারমাইন্ডসহ গ্রেফতার বাকি তিনজনের নাম জানানো হয়নি।

শুক্রবার রাত ১২টার দিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়-‘বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এবং টিপুকে অনুসরণকারীসহ চারজনকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।’

এর আগে ওই হত্যা মামলায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ; যারা এখন রিমান্ডে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এ খুনের ঘটনায় এ বিষয়ে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানোর কথা বলেছে পুলিশের বিশেষ এ ইউনিট।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ