মাঙ্কি পক্স নিয়ে আতঙ্ক নয়

করোনাভাইরাস যেতে না যেতেই বিশ্বজুড়ে আবার আলোড়ন তৈরি করেছে মাঙ্কি পক্স ভাইরাস। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১২টি দেশে ৯২ জনের মধ্যে এ রোগটি শনাক্ত হয়েছে। সংক্রামক এ রোগটি কি আবার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? এটিও কি মহামারি আকার ধারণ করবে? চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেই এ রোগটি সম্পর্কে।

* মাঙ্কি পক্স কী

এ রোগটি মাঙ্কি পক্স নামক ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। ১৯৫৮ সালে প্রথম ড্যানিশ ল্যাবরেটোরিতে বানরের মধ্যে এ ভাইরাসটি আবিষ্কৃত হয়। মানুষের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ড্যামোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ১৯৭০ সালে। এর দুটি ধরনের মধ্যে একটি হলো পশ্চিম আফ্রিকান অপরটি মধ্য আফ্রিকান। এ ক্ষেত্রে, পশ্চিম আফ্রিকান (৩.৬%) ধরনের তুলনায় মধ্য আফ্রিকান (১০.৬%) ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।

ইতঃপূর্বে মাঙ্কি পক্সের রোগী সচরাচর পাওয়া যায়নি এমন ১২টি দেশে সম্প্রতি ৯২টি কেস শনাক্ত হয়েছে, যার ফলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে এসব কেস শনাক্ত হয়েছে, যার সবকটিই পশ্চিম আফ্রিকান ধরনের।

মাঙ্কি পক্সের লক্ষণগুলো অনেকটা স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের মতো। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, এটি স্মলপক্স থেকে কম সংক্রামক এবং কম গুরুতর। ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যেই রোগী আরোগ্য লাভ করে। এ ছাড়া মৃত্যুহারও কম।

* মাঙ্কি পক্সের উপসর্গ

মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হওয়ার সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে ৫ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায়। এতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, পিঠে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা এবং দুর্বলতা দেখা যায়। তবে গুটিবসন্ত থেকে এর প্রধান পার্থক্য হল এতে লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফ নোড (গলায়, বোগলে ও কুঁচকিতে কিছু গ্রন্থি) ফুলে ওঠে।

সাধারণত প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, প্রথমে মুখে এবং পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যৌনাঙ্গ এবং পায়ুপথের আশপাশে ফুসকুড়ি সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে। এ ফুসকুড়িগুলো পরে ফোসকায় পরিণত হয় এবং প্রচণ্ড পরিমাণে চুলকানি ও ব্যথা হয়।

মাঙ্কি পক্সের উপসর্গ প্রকাশ পেলে আক্রান্ত ব্যক্তি সংক্রামকে পরিণত হয় অর্থাৎ অন্যদের মধ্যে এ রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে। সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত এ রোগটি স্থায়ী হয় এবং রোগী নিজ থেকেই সেরে ওঠে। এ রোগের উপসর্গগুলো সাধারণত মৃদু আকারে প্রকাশ পায়, তবে ক্ষেত্রবিশেষে শিশু, গর্ভবতী বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য এ রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে, এ রোগে মৃত্যুহার ৩-৬%।

* জটিলতা

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঙ্কি পক্সের কারণে শরীরে কিছু জটিলতা দেখা যায়। যেমন-শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে (ফুসফুস, ব্রেইন ও চোখ) ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে। চোখের কর্ণিয়ায় ইনফেকশন ছড়িয়ে গেলে রোগী দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলতে পারে।

* যেভাবে মাঙ্কি পক্স ছড়ায়

সাধারণত মাঙ্কি পক্স মানুষ থেকে মানুষে খুব সহজে বিস্তার লাভ করে না। কিন্তু আক্রান্ত প্রাণী বা ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে এলে অথবা শরীরে থাকা ক্ষত বা ফোসকার সংস্পর্শে এলে এ রোগ সুস্থ দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মেলামেশা এ রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারণ। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, থুতু কিংবা দীর্ঘক্ষণ মুখোমুখি আলাপচারিতার ফলেও মাঙ্কি পক্স ছড়াতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদির (যেমন-পোশাক, বিছানা, তোয়ালে ইত্যাদি) সংস্পর্শে এলেও এটি বিস্তার লাভ করতে পারে।

* চিকিৎসা

কারো শরীরে ফুসকুড়ি এবং সঙ্গে জ্বর, অবসাদ্গ্রস্ত কিংবা অস্বাভাবিক দুর্বলতা দেখা দিলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাঙ্কি পক্স ভাইরাসের পরীক্ষা করাতে হবে। মাঙ্কি পক্স শনাক্তের ক্ষেত্রে পিসিআর পরীক্ষাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এক্ষেত্রে ত্বকের ক্ষত স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া বায়োপসির মাধ্যমেও এ রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব। মাঙ্কি পক্স ভাইরাস এ সাস্পেক্টেড অথবা পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই শরীরের ফুসকুড়ি ঝরে যাওয়া পর্যন্ত আলাদা অবস্থান করতে হবে এবং সব ধরনের শারীরিক মেলামেশা থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঙ্কি পক্স রোগের প্রকোপ কমাতে চিকিৎসকের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া, আক্রান্ত ব্যক্তির সেবাদানকারীকে অবশ্যই যথাসম্ভব নিজেকে সুরক্ষার কলাকৌশল অবলম্বন করতে হবে।

মাঙ্কি পক্সের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তাই এ রোগে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়, সেগুলো কমানোর জন্য চিকিৎসক ওষুধ প্রদান করে থাকেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের টিকা এ রোগ প্রতিরোধে প্রায় ৮৫% কার্যকর। এ ছাড়া অনেক দেশে অ্যান্টিভাইরাল এবং ইমিউনোগ্লোবিন ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

* মাঙ্কি পক্স প্রতিরোধে করণীয়:

মাঙ্কি পক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে নিুোক্ত বিষয়গুলো যথাযথভাবে মেনে চলা প্রয়োজন।

* মাঙ্কি পক্সের উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তির খুব কাছাকাছি থেকে কথা বলা এবং শারীরিক সংস্পর্শ পরিহার করা।

* কোনো পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে, তাকে আলাদা রুমে রাখা এবং পরিবারের সবার মাস্ক ব্যবহার করা।

* যথাসম্ভব যৌন মেলামেশা এড়িয়ে চলা, বিশেষ প্রয়োজনে কনডম ব্যবহার করা।

* মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কোনো দ্রব্যাদির সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা।

* যেহেতু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে, সেহেতু সার্জিক্যাল মাস্ক পরিধান করা।

* নিয়মিত সাবান অথবা অ্যালকোহল সম্পন্ন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা।

* রান্নার সময় মাংস ভালো মতো সিদ্ধ করা।

* অসুস্থ, মৃত অথবা বন্য কোনো প্রাণীর সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকা।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো মাঙ্কি পক্সের বিস্তার ততটা প্রকোপ নয়। তাই সময় থাকতে রোগটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নিয়ে সচেতন থাকাই মাঙ্কি পক্স প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়।

লেখক : রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, সেন্টার ফর রিসার্চ, ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট একশন (CRIDA), কানাডা।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ