মতিঝিলের রবিন সোহেল টিটু ও খায়রুল গ্রেফতার

রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৫) ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি (২২) হত্যার তদন্ত ফের গতি পেয়েছে।

গ্রেফতার হওয়া ১৬ জনের জবানবন্দির সূত্র ধরে এবার রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

বিশেষ করে খুনের সন্দেহভাজন সমন্বয়কারী সুমন সিকদার মুসাকে ওমান থেকে দেশে আনার পর আদালতে তার দেওয়া জবানবন্দিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।

এরই অংশ হিসাবে শনিবার মতিঝিল ও আশপাশের এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

তারা হলেন-জুবের আলম খান রবিন, আরিফুর রহমান সোহেল (ঘাতক সোহেল), খায়রুল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুর রহমান টিটু।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মতিঝিলের প্রগতি সংঘের উপদেষ্টা ছিলেন প্রয়াত যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী। এই সংঘ ঘিরেই মিল্কীর সঙ্গে রবিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ড নামের বিপণিবিতানের সামনে গুলিতে নিহত হন যুবলীগ নেতা মিল্কী। আবার মিল্কী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু।

অন্যদিকে গ্রেফতার মাহবুবুর রহমান টিটু কাউন্সিলর মনসুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসাবে মতিঝিল এলাকায় পরিচিত। তিনি মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।

এলাকায় অনেকে তাকে মনসুরের ‘পিএস’ হিসাবেও ডেকে থাকেন। টিপু হত্যার মিশনে অর্থ সরবরাহসহ সংশ্লিষ্ট কাজে পরোক্ষভাবে তার সম্পৃক্ততার কথা বিভিন্ন সময় টিপুর ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে উঠে আসে।

আর ঘাতক সোহেল মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক। সর্বশেষ রাত ১১টার দিকে মতিঝিলের আরামবাগ থেকে গ্রেফতার হওয়া খায়রুল সোহেলের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।

টিটুর বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ‘টিটু একসময় মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল, ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী।

আমি যেহেতু দল করি, মহানগর আওয়ামী লীগে আছি, কাউন্সিলর-সেই হিসাবে আমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। আর যে জন্য আপনারা আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন। সেটার সঠিক বিচার হোক আমিও চাই।’

পিএস পরিচয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সরকারি একজন সচিব আছেন। তাছাড়া কোনো পিএস-এপিএস নাই।’

টিটু তার আশীর্বাদে মতিঝিলে চলত-এমন অভিযোগের বিষয়ে কাউন্সিলর বলেন, ‘সে ছাত্রলীগ করেছে, আমি তাকে খুব ভালোভাবেই চিনি। আমার জানা মতে ভালো দেখেছি, আমার কাছাকাছি থাকত। আরও অনেকেই তো কাছাকাছি থাকত। এতুটুকুই।’

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ইতঃপূর্বে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রবিন, টিটু ও ঘাতক সোহেলকে গ্রেফতার করা হয়।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এখনই তাদের বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলতে পারি, এ ঘটনায় যে পর্যায়ের যারাই জড়িত থাকুক, আমরা কাউকেই ছাড় দেব না। সবাইকে আইনের আওতায় আসতে হবে।

ডিসির এই বক্তব্য নেওয়ার পর রাতে মতিঝিলের আরামবাগ থেকে খায়রুলকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে সুমন সিকদার মুসার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর রহস্যজনক কারণে গতি হারায় আলোচিত এই জোড়া খুনের তদন্ত। একাধিক সূত্রের দাবি, জবানবন্দিতে মুসা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতাসহ অন্তত সাতজনের নাম বলেছে।

সবাই টিপু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে দাবি করেছে সে। টিপুর পরিবারের দাবি ছিল, মুসার জবানবন্দিতে মতিঝিল এলাকার অনেক রাঘববোয়ালের নাম উঠে আসায় মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া থমকে যায়।

শনিবার নতুন করে দুজনকে গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি যুগান্তরকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি খুনের পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও কিলিং মিশনে জড়িতদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের ধরতে হবে।

ডিবি যদি সেটি করে থাকে তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমরা চাই না প্রভাবশালীদের কারণে তদন্ত থেমে যাক। রাঘববোয়ালদের গ্রেফতার করলেই বেরিয়ে আসবে হত্যার আসল রহস্য। তাই জবানবিন্দতে আসা প্রত্যেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হোক।

এদিকে টিপু খুনের মামলার তদন্তকারী সংস্থা ডিবি ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মুসাকে ফেরানোর পরই এই হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।

এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো-টিপু হত্যায় ব্যবহৃত গুলি নেওয়া হয়েছে পুরানা পল্টনের ‘আর্মস মিউজিয়াম’ নামের একটি অস্ত্রের দোকান থেকে।

এই দোকানের মালিক ইমরান হোসেন জিতুর (৩২) কাছ থেকে ১৫ রাউন্ড গুলি নিয়ে খুনের সন্দেহভাজন সমন্বয়কারী সুমন সিকদার মুসার কাছে পৌঁছে দেয় মতিঝিলের ১০নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা রাকিবুর রহমান রাকিব।

সেই গুলিগুলোই ব্যবহার হয় টিপুর ‘কিলিং মিশনে’ ব্যবহৃত অস্ত্রে। আর দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টির নির্দেশে ইশতিয়াক আহমেদ জিতু নামের একজন মগবাজারের বাসা থেকে মোল্লা শামীমের কাছে অস্ত্রটি সরবরাহ করে।

কিলিং মিশনের আগে সেই অস্ত্রটিই দেওয়া হয় শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশের হাতে। অস্ত্রটিতে দুই রাউন্ড গুলি ছিল। পরে তাতে আরও ১০-১২ রাউন্ড গুলি ‘লোড’ করা হয়।

এখানে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে জিসান ও শামিম ছাড়া সবাই গ্রেফতার হয়েছেন। শামীম কিলিং মিশন বাস্তবায়নকালে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন। তাকে দেশে ফেরাতেও অগ্রগতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সড়কে প্রকাশ্য গুলি করে খুন করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতিকে।

পেশাদার কিলার বাহিনী এক থেকে দেড় মিনিটের অপারেশন শেষে পালিয়ে যায়। ১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে টিপুর দিকে। এর মধ্যে তার শরীরে সাত রাউন্ড গুলি লাগে। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থলে সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি (২২) নামের এক নিরীহ কলেজছাত্রী নিহত হন।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ