পাকুল্লার তিন গম্বুজ মসজিদ

মোগল আমলের শেষ নিদর্শন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লার তিন গম্বুজ মসজিদ। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর উপজেলার জামুর্কী ইউনিয়নের পাকুল্লা বাজারে এই মসজিদ অবস্থিত।

প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে তিন গম্বুজ নিয়ে স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। আর গম্বুজ তিনটি মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মসজিদটির বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ১৪.৭৭ মিটার ও প্রস্থ ৫.৮৫ মিটার। এর দেয়াল ১.২৫ মিটার প্রশস্ত। পাকুল্লা মসজিদের অভ্যন্তরভাগ আড়াআড়ি খাঁজ খিলান দ্বারা তিনটি অসম ভাগে বিভক্ত। খিলানগুলো পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালের নিচ থেকে উত্থিত। এ ধরনের খিলানের সাদৃশ্য দিল্লিতে অবস্থিত আওরঙ্গজেবের আমলে মতি মসজিদ (আনু. ১৬৬২ খ্রি.), বর্ধমানে খাজা আনোয়ার শহীদের সমাধি (আ. ১৬৯৮ খ্রি.) এবং ঢাকার কাজী খাজা শাহবাজের মসজিদে (আনু. ১৬৭৯ খ্রি.) দেখা যায়।

পাকুল্লা মসজিদের তিনটি গম্বুজই অষ্টভুজাকৃতির ড্রামের উপরে স্থাপিত এবং কেন্দ্রীয় গম্বুজটি পার্শ্ববর্তী অপর দুটি অপেক্ষা বৃহৎ।

ধারণা করা হয়, এটি মোগল সম্রাট বাবরের নাতি আকবরের শাসন আমলের পর আওরঙ্গজেবের সময় মসজিটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে এটি মাইলফলক হিসেবে সমাদৃত। ধারণা করা হয়, এটি উপজেলার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ।

পাকুল্লাগ্রামের প্রবীণ সাবেক সেনাবাহিনীর সুবেদার পাকুল্লা পূর্ব পাড়া মসজিদ কমিটির সভাপতি মোঃ আব্দুস সালাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার বাবা ও তাদের পূর্বপুরুষরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন বলে শুনেছি।

পাকুল্লা জমিদার বাড়ির সন্তান মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলী আহসান চৌধুরী কিছুদিন আগে মারা যাওয়াতে বর্তমানে মসজিদটি দেখা শোনার কাজ করছেন তারই ছোট ভাই জামুর্কী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলী এজাজ চৌধরী রুবেল। তিনি বলেন, অনেক দুর থেকে মুসুল্লিরা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসতেন।

পাকুল্লা বাজারের স্থানীয় কাপড় ব্যবসায়ী মোঃ মুন্নাফ খান নয় দিগন্তকে বলেন, আমিও এ মসজিদে নামাজ আদায় করি। আমার বাবা ও আমার দাদারাও এ মসজিদে নামাজ আদায় করতেন।

জানা যায়, মসজিদটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ইটের গুঁড়ি, চুনাপাথর ও সুরকি। ৬০ ফুট লম্বা ও ২৫ ফুট প্রস্থের মসজিদের প্রতিটি দেওয়াল ৫০ ইঞ্চি পুরু। আয়তাকৃতির মসজিদের উভয় দিকে একটি করে দোচালা রীতির ইট ও পলেস্তরায় নির্মিত কক্ষ রয়েছে। এ দুটি কক্ষ কি উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। সম্ভবত ছাত্রদের পড়ার স্থান অথবা মসজিদের ইমামের থাকার জায়গা হিসেবে কক্ষ দুটি ব্যবহার হতো। দুটি কক্ষেই মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ থেকে ঢোকার দরজা রয়েছে।

মসজিরে সম্মুখে তিনটি প্রবেশ পথ আয়তাকৃতির প্যানেলের মধ্যে স্থাপিত এবং উপরে তিনটি গম্বুজ। চারকোণে চারটি অষ্টভুজাকৃতির পার্শ্ব বুরুজ ছাদের উপর পর্যন্ত উঠে গেছে।

বুরুজগুলোর উপরের ছত্রী এবং কুপোলা কলস ফিনিয়ালে সমাপ্ত হয়েছে। পার্শ্ব বুরুজ ও সংলগ্ন ক্ষুদ্র বুরুজগুলো কলস ভিত থেকে উত্থিত। যার ভেতরে-বাইরে নানা কারুকাজ খচিত। প্রাচীন স্থাপত্যের পিলারগুলোতে কোনো লোহা বা রড ব্যবহার করা হয়নি।

পশ্চিম দেয়ালের ভেতরে তিনটি অবতল মিহবার আছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব চতুষ্ক্রেন্দ্রিক বহু খাঁজবিশিষ্ট এবং পার্শ্ব মিহরাবগুলো খাঁজবিহীন। কেন্দ্রীয় মিহরাব পার্শ্ব মিহরাবদ্বয় থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ঐতিহ্যগতভাবে বহির্দিকে বর্ধিত এবং উভয় দিকে জোড় স্তম্ভ রয়েছে। আর পার্শ্ববর্তী মিহরাবে একটি করে কলাম মিহরাবের উভয় পার্শ্বে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় মিহরাবের উত্তর পাশে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট মিম্বার। সুডৌল কন্দাকার গম্বুজ পদ্ম ফুল আচ্ছাদিত কলস ফিনিয়ালযুক্ত। মসজিদের প্যারাপেট দেয়াল ও গম্বুজের নিচে ড্রামের চারদিকে পদ্মপাপড়ির মেরলোন নকশা সম্বলিত।

রজার ও মিহরাবের সর্বত্র আকর্ষণীয়ভাবে পলেস্তরার স্ট্যাকো নকশায় পদ্মপাপড়ির মেরলোন, ড়ি, পাতা, জ্যামিতিক নকশায় ও অন্যান্য ফুলেল নকশায় অলংকৃত। পাকুল্লা মসজিদে শিলালিপি না থাকায় এটি নির্মাণের তারিখ জানা যায় না। কিন্তু স্থাপত্য রীতির দিক দিয়ে অন্যান্য মধ্যযুগীয় তারিখযুক্ত খাজা আনোয়ার শহীদের সমাধি (আনু. ১৬৯৮ খ্রি.), মানিক পীরের রগাহ (১৬৯৭), করতলব খান মসজি (১৭০৪ খ্রি.) ইত্যাদি ইমারতের সাথে মিল থাকায় পাকুল্লা মসজিদ ষোলশ শতকের শেষ দিকে সতেরো শতক অথবা আঠারো শতকের প্রারম্ভে নির্মিত বলে অনায়াসে ধরা যায়। বর্তমানে মসজিদটি ভগ্নদশাগ্রস্ত এবং এর দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে।

আরো জানা যায়, মসজিদের নামে প্রায় ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। এর দক্ষিণ পাশেই আছে বিশাল পুকুর। আর মসজিদে একসঙ্গে শতাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। জুম্মার দিন মসজিদের ভিতর ও বাহিরে প্রায় ১২ শ’ মুসল্লিরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

পাকুল্লা তিন গম্বুজ মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মুফতি মোস্তাফা বলেন, উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীনতম এ মসজিদের ইমামতি করতে পারায় তিনি গর্ববোধ করেন।

মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ হাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, এ মসজিদটি সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে তিন গম্বুজ নিয়ে স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে শুনেছি। আর গম্বুজ তিনটি মসজিরে সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। পাকুল্লা মসজিদ ষোলশ শতক এর শেষ দিকে সতেরো শতক অথবা আঠারো শতকের নির্মিত বলে জানতে পেরেছি।এটি উপজেলার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক মোঃ গোলাম ফেরদৌস নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে অনেক মসজিদ রয়েছে যার সব তথ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাছে নেই। মোগল আমলের অনন্য স্থাপত্য শেষ নিদর্শন হতে পারে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লার তিন গম্বুজ মসজিদ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালকের বরাবর লিখিত আবেদন ওই মসজিদ কমিটি করলে প্রাচীন স্থাপত্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ