রকমারি ধান থেকে চাল করা হয় চাতালে, নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। চাতালে ধান থেকে চাল করার প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে রয়েছে তাদের ঘাম ঝরানো শ্রম। এ কাজে নিয়োজিত থাকেন অধিকাংশ নারী শ্রমিক। এ নারী শ্রমিকরাই স্থানীয়ভাবে ‘চাতাল-কন্যা’ নামে পরিচিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প ও বন্দর নগরী আশুগঞ্জে রয়েছে চার শতাধিক ছোট-বড় বয়লার রাইস মিল বা চালকল। এসব চাতাল কলে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন দশ হাজারেও বেশি নারী-শ্রমিক।
দেশব্যাপী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’ – এ প্রতিপাদ্য নিয়ে। তবে এ দিবস সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা জানার আগ্রহ কোনোটিই নেই এসব চাতাল-কন্যাদের। অর্থনৈতিক দীনতা, রোগ-শোক আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভেতর দিয়েই চলে এ চাতাল-কন্যাদের জীবনধারা।
সরেজমিনে আশুগঞ্জের বিভিন্ন চাতাল মিল পরিদর্শন করে জানা যায়, চাতাল-কন্যাদের কাজটা খুবই ক্লান্তিকর। মাঠে গায়ের ঘাম ঝড়িয়ে কঠোর পরিশ্রম করে ধান থেকে চাল উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাজ করে তারা। তাদের কাজে কোনো ফাঁকি দিতে দেখা যায় না কখনো। কিন্তু সে হিসেবে তাদের শ্রমের মজুরি খুবই কম। পুরুষের সমান বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি শ্রম দিয়েও চাতাল-কন্যারা মজুরী পান পুরুষের অর্ধেকের চেয়েও কম।
এদিকে দিনে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ টাকা হারে পারিশ্রমিক দিয়ে বয়লার মালিকরা চাতাল-কন্যার শ্রম কিনে ব্যবসা করছেন। আর তার বিপরীতে চাতাল-কন্যাদের জীবনের প্রতিটি দিন কাটছে অভাব-অনটন আর অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাড়াও ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলার আমতলী, ফরিদপুরের নড়িয়া ও খুলনার কায়রা উপজেলার হতদরিদ্র নারীরা নিজ এলাকায় কাজ না পেয়ে দলবেঁধে আশুগঞ্জের বিভিন্ন চালকলে কাজ করতে আসেন। চাতালে ধান থেকে চাল করা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। ধান থেকে চাল ছাড়াতে দিন-রাত শ্রম দিতে হয় তাদের।
প্রতিটি চাতালে ৪০ জন নারী শ্রমিকের বিপরীতে পুরুষ কাজ করেন ১৫ থেকে ১৬ জন। একজন পুরুষ সর্দারের অধীনে ধান শুকানো, মিলে ভাঙানো, বস্তায় চাল ভরা – এসবই নারী শ্রমিকদের প্রধান কাজ। চাতালে ধান আনা, সেদ্ধ করা পুরুষ-শ্রমিকদের কাজ হলেও এসব কাজে নারীরাও অংশ নেন।
এদিকে আবার সেদ্ধ ধান শুকাতে গড়ে দুই দিন সময় লাগে। আর আবহাওয়া খারাপ থাকলে এতে ৩ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। নারী-শ্রমিকরা প্রতিমণ সেদ্ধ ধান প্রক্রিয়াজাত করে সাড়ে ১০ টাকা, আতপ চাল ৮ টাকা এবং বয়লারে কাজ করলে ১০ টাকা হারে পারিশ্রমিক পান।
‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও অর্থনৈতিক দীনতা, রোগ-শোক আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভেতর দিয়েই এ চাতাল-কন্যাদের জীবন কাটে। তাদের ছোট জরাজীর্ণ স্যাঁতসেঁতে ঘরে না পৌঁছে শিক্ষার আলো, না পৌঁছে স্বাস্থ্য-সেবা, না পৌঁছে নাগরিক সুবিধা! পরিবার পরিকল্পনা কী তাও জানেন না তারা। প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত প্রত্যেক নারীর গড়ে ৫ থেকে ৬ জন করে সন্তান রয়েছে।
অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর সুষম খাদ্যের অভাব যেন তাদের নিত্যসঙ্গী! ছোট বড় সবাই ভুগছেন পুষ্টিহীনতায়। ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে প্রতিবছর গড়ে ১৫ থেকে ১৬টি শিশুর মৃত্যু হয় বলে এক সমীক্ষায় জানা যায়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাতাল-কন্যারা স্থানীয় মাস্তানদের উপদ্রবের শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অনাদরে-অবহেলায় কিশোরীসহ অল্পবয়স্ক নারী-শ্রমিকদের অনেকে জড়িয়ে পড়ে দেহ ব্যবসার মত পঙ্কিল পেশায়।
চাতাল-কন্যা রশিদা ও মালেকা বেগমসহ অনেকেই জানালেন, একই কাজ ও সমান পরিশ্রম করা সত্ত্বেও পুরুষদের তুলনায় তারা অনেক কম মজুরি পেয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পান না তারা। তারা জানান, দিনে মাত্র ৪০-৫০ টাকা আয় দিয়ে তাদের সংসার চলে না। যেখানে একজন পুরুষ পায় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা পায়, সেখানে তার একই কাজ করে বৈষম্যের শিকার হন চাতাল-কন্যারা।
এছাড়া গড় মৌসুমে চাতাল মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয়।
তারা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরার শ্রম দিয়া বয়লার মালিকরা আরাম-আয়েশ করেন, ভোগ করেন। কিন্তু ঈদ ছাড়া আমরার রিযিকে কখনো গোশত জোটে না।’
নারী শ্রমিকদের প্রতি এ বৈষম্যের কথা স্বীকার করে চাতালে কর্মরত বেশ কয়েকজন পুরুষ শ্রমিক জানান, মহিলাদের অন্য কাজের সুযোগ কম বলে মালিকরা এ সুযোগটা নিচ্ছেন।
বয়লার মালিক উবায়দুল্লাহ ও কামরুজ্জামান রিপন কিছুটা বৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, এটি দীর্ঘদিনের নিয়ম ও প্রথাগতভাবে চলছে। এছাড়া মহিলা ও পুরুষের কাজে কিছুটা বেশ-কম রয়েছে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারাদেশে আড়ম্বরপূর্ণভাবে দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। কিন্তু এ চাতাল-কন্যারা নারী দিবস কী – তা জানেন না। জানার আগ্রহও নেই তাদের। ঘুম ভেঙেই চোখ মুছতে মুছতে তাদের দৌড়াতে হয় চাতালে। সেই ফাঁকে স্বামী-সন্তানদের জন্য রান্না-বান্নাও সারতে হয়। শ্রম, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সমাজের সবক্ষেত্রে নারীদের প্রতি এ বৈষম্যের অবসান নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই তাদের।