দৈহিক ওজন কমানোর পদ্ধতি

দেহের ওজন কেন বাড়ে?

দৈহিক ওজন বৃদ্ধির মূল কারণ হলো শক্তি ও তার ব্যবহারের মধ্যে অসঙ্গতি। আমাদের গৃহীত প্রায় প্রতিটি খাবারেই শক্তি ক্যালরি হিসাবে থাকে। আমরা আমাদের পছন্দ, সামর্থ্য ও অভ্যাস অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করে থাকি। মানুষের বয়স, লিঙ্গ, ওজন আর দৈনন্দিন কাজের ওপর শরীরে ক্যালরির চাহিদা নির্ভর করে। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি তার প্রাত্যহিক চাহিদার চেয়ে বেশি ক্যালরি প্রতিদিন বা প্রায়শই খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে তবে তার বাড়তি অংশ শরীরে মেদ হিসাবে জমতে থাকবে অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার খেলে শক্তি গ্রহণের তুলনায় যদি ক্যালরি খরচ কম হয় তাহলে দেহের ওজন বাড়তে থাকবে। বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণই যদিও দৈহিক ওজন বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ। খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রভাব আছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ওই মানুষটি জেনেটিক প্রভাবে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।

ওজন কেন কমাবেন?

দৈহিক স্থূলতা একটি রোগ। ওজন বৃদ্ধির কারণ যাই হোক না কেন বর্ধিত ওজন নানাবিধ শারীরিক সমস্যা এবং অসুখের কারণ হতে পারে। তাই বর্তমানে সুস্থ থাকা এবং ভবিষ্যতে দৈহিক ওজন বৃদ্ধির কারণে কোনো রোগের ঝুঁকি কতটুকু বেড়ে যেতে পারে তার একটি তালিকা নিম্নরূপ-

* প্রতি ২-৩ কেজি ওজন বাড়ার কারণে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

* উচ্চরক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

* পৃথিবীতে যত মানুষ হৃদরোগে ভোগে তার ৪০ শতাংশ বেশি হয় ওজন বৃদ্ধির কারণে।

* শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

* সন্তান ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে (মহিলাদের)।

* মানসিক অবসাদে ভুগতে পারে।

দৈহিক ওজন কমিয়ে অনেক রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমানো যেতে পারে। মাত্র ৫-১০ শতাংশ ওজন কমিয়ে অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়া যায়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। যারা ইতোমধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের ওজনের পরিমাণও কম লাগবে।

* উচ্চরক্তচাপে ভোগার ঝুঁকি কমবে।

* রক্তে ক্ষতিকর কলস্টেরল কমতে সাহায্য করবে এবং উপকারী কলস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করবে।

* আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা।

* শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি ঘটায়।

* রাতে ভালো ঘুমের সম্ভাবনা বাড়ায়।

ওজন কীভাবে কমাবেন?

ওজন যদি বেশি থাকে তবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অতি সত্বর কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ওজন কমানোর ও ওজন বৃদ্ধির হার হ্রাস করার কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা দেয়া হলো।

* ওজন কমানোর প্রথম ধাপ হলো-জীবন ধারায় কিছু পরিবর্তন আনা। এর মধ্য সামগ্রিক জীবনের শৃঙ্খলা বোধ, খাদ্য গ্রহণে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং নিয়মিত দেহিক পরিশ্রম করা অন্যতম।

* ওজন কমাতে নিয়ে কখনই খুব বেশি তাড়াহুড়া করা উচিত হবে না। তাড়াহুড়া করে ওজন কমিয়ে কিছু দিন পর আবার ওজন বৃদ্ধি পেলে তা আগের তুলনায় বেশি ক্ষতির কারণ হবে। অতিদ্রুত দৈহিক ওজন কমানোর জন্য শরীরের বিপাকীয় অসামঞ্জস্য দেখা দেবে। এ জন্য প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে ১টি পরিবর্তন অভ্যাস করুন এবং এ অভ্যাসটি আপনার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। যেমন ধরুন, আপনার ফল খাবার অভ্যাস নেই। আপনি প্রতিদিন ১ টুকরা করে ফল খেতে শুরু করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এবং মোটামুটি নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন।

* খাদ্য তালিকায় কম ক্যালরি প্রদান করে এমন খাদ্য বেশি রাখুন। এ খাদ্যগুলো হলো-শাকসবজি, কাঁচা টক ফল ইত্যাদি। যারা ইতোমধ্যে স্থূলকায় হয়ে গেছেন তাদের বেলায় ভাত, রুটি, মাছ, মাংস ইত্যাদি শাকসবজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। আগে সারা দিনে যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করতেন, এখনো সে পরিমাণেই করতে পারবেন যদি খাদ্য তালিকায় ক্যালরি দেয় এমন খাদ্য কমিয়ে আনা হয়। যেমন ধরুন, আপনি দুপুরে মোট ৮০০ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করেন। এখন ৫০০ গ্রাম শাকসবজি রাখুন। আর ৩০০ গ্রাম ভাত-রুটি, মাছ-মাংস রাখুন। সকালে ডিম খাওয়া ত্যাগ করুন শুকনো রুটি ও সবজি খাবেন। রাতে ভাত-রুটি কম খাবেন।

* মিষ্টিজাতীয় খাদ্য যতটা সম্ভব কম খাবেন।

* চা পান করলে এতে ১ চামচের বেশি চিনি দেবেন না।

* উপাদেয় ও বিখ্যাত খাদ্যগুলো প্রায় সব সময়ই বর্জন করতে হবে। যেমন-পোলাও, বিরিয়ানি, মোগলাই, কাবাব ইত্যাদি। একদিনের খাদ্যের কারণে বহুদিনের অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় নিপতিত হওয়া থেকে বিরত থাকুন।

ওজন কমাতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষ যে পদ্ধতির আশ্রয় নেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা স্বাস্থ্যসম্মত হয় না। যেমন ধরুন, ওজন কমানোর জন্য আপনি সহসা খাদ্য গ্রহণ খুব কমিয়ে দিলেন। এটি মোটেও কাঙ্খিত নয়। আপনার কতটুকু ওজন কমানো দরকার এবং তা কতদিনের মধ্যে করতে হবে সেটি ঠিক করে তারপর প্রত্যহ কতটুকু করে খাদ্য কম খেতে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। কিছু কিছু খাদ্য-পানীয় আমরা কোনো হিসাব না করেই খাই। এগুলোর বেশ কটি খাদ্য-পানীয় বেশ জনপ্রিয়। অনেক মানুষের আবেগজড়িত হয়ে গেছে এসব খাদ্য-পানীয়ের সঙ্গে। কিন্তু এদের অধকাংশই বাহুল্য এবং বর্জনীয়। যেমন ধরা যাক, কোমল পানীয়। একটি ২৫০ মিলিমিটারের কোমল পানীয়ের বোতলে কমপক্ষে ১ চামচ চিনির সমপরিমাণ মিষ্টি থাকে। তারপর আছে ফাস্টফুডজাতীয় খাদ্য, যদি কেউ তার প্রধান একটি খাদ্য বাদ দিয়ে ফাস্টফুড খায় তবে খুব বেশি সমস্যা নেই। কিন্তু যদি সেটি হিসাবের বাইরের কোনো খাবার হয় তবে অবশ্যই তা ওজন বৃদ্ধির কারণ হবে। অতএব, ওজন কমাতে চাইলে এসব খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কেউ যদি তার দৈহিক ওজন কমাতে ব্যর্থ হন তবে তার জন্য কিছু ওষুধ রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবহারের আগে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাসের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও শারীরিক শ্রমের নির্দেশিত মাত্রা কম পক্ষে তিন মাস প্রয়োগ করতে হবে। যদি তা ব্যর্থ হয় তবে ওষুধ ভাবার বিবেচনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করতে হবে এবং নিয়মিত তার তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। আমাদের দেশে দেহের ওজন কমানোর ওষুধগুলোর মধ্যে আছে অরলিস্ট্যাট।

খাদ্যের ক্যালরি কমানোর সহজ উপায়

* যথাসম্ভব বর্জন করুন-ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, ভাজা খাবার, তৈলাক্ত খাবার। নির্ধারিত খাবারের মাঝে মাঝে এটা-সেটা খাবারও বর্জন করুন।

* খাবারের শেষে মিষ্টি খাবার খাবেন না চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাদ্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

* বেশি করে শাকসবজি ও ফলমূল খাবেন। বেশি করে মাছ খাবেন। চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস ও গরু-খাসির মাংস কম খাবেন।

* ডিমের সাদা অংশ খাবেন। কুসুম বাদ দেবেন।

* দুধ চিনি ছাড়া হলে চা-কফিতে কোনো বাধা নেই। কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করতে পারেন।

* রান্নায় বেশি পানি ব্যবহার করুন। তেল ও মসলা যতটা সম্ভব কম দেবেন। ভুনা খাবার খাওয়া বাদ দেবেন।

* দই, নারিকেল, ঘি, ডালডা-এসব দিয়ে রান্না করবেন না।

* সয়াবিনে ৬-৮ গ্রাম জল পান করুন। প্রতিবার খেতে বসার আগে ১ থেকে ২ গ্রাম জল পান করুন। ভাত দ্রুত ও স্থায়ীভাবে আপনার পেট ভরার অনুভূত থাকবে।

* খাবার সময় টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া বা বন্ধুর সঙ্গে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গল্প করা থেকে বিরত থাকুন।

* সরবর্জিত দুধ পান করবেন।

* তাজা ফল খাবেন, কাস্টার্ড বা জুস নয়।

* উচ্চ ক্যালরি খাদ্যগুলো বাদ দিয়ে নিম্নক্যালরি খাদ্যগুলো খাবেন।

প্রতিদিনের দৈহিক শ্রম

প্রত্যহ কমপক্ষে ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করার চেষ্টা করুন। একটানা ৩০ মিনিট সম্ভব না হলে ২ বা ৩ বারে তা করুন।

এমন কিছু দিয়ে শুরু করুন যা আপনার জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে যাবে। হাঁটা সবচেয়ে ভালো। বিকল্প হিসাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ব্যাডমিন্টন বা টেনিস খেলার কথা চিন্ত করতে পারেন।

* শারীরিক শ্রমের বেলায় নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে চলার চেষ্টা করুন।

* নিজের কাজগুলো নিজে করার চেষ্টা করুন।

* বাগান করা, বাড়ি বা ঘর পরিষ্কার করা, কাপড়, ধোয়া বা অন্যান্য দেখাশোনা করার অভ্যাস করুন।

* অফিসে যাওয়ার সময় হাঁটার অভ্যাস করুন এবং অফিস বা বাসার লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে উঠার চেষ্টা করুন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ