সমুদ্র গবেষণার মতো কাজ চলছে ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে। অবিশ্বাস্য হলেও যা সত্য। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই হালকা যন্ত্রপাতি দিয়ে এমন দায়সারা গবেষণা চালানো হচ্ছে ২০১৭ সাল থেকে। গভীর সমুদ্রের তলদেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে বিশদ গবেষণা করার প্রয়োজন থাকলেও সেটি হচ্ছে না। তীর থেকে মাত্র ৫-৭ কিলোমিটারের মধ্যে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে একেবারে প্রাথমিক গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রথম ধাপে ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০২ কোটিতে। তবে ওই অর্থ দিয়ে বাস্তব গবেষণার কাজ তেমন একটা শুরু কর যায়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ধাপে ৪৪৩ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রকল্পটি শিগগির জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা শুরু করা সম্ভব হবে। এরফলে সমুদ্রের বিশাল সম্পদকে কাজ লাগানোর নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। গবেষণায় পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে ব্লু-ইকোনমি (সুনীল অর্থনীতি) উন্নয়নে দৃশ্যমান সফলতা আসবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহাম্মদ রোববার বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটটির জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। সামান্য কিছু যন্ত্রপাতির সংস্থান ছিল। এমনকি প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকায় ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে কর্মকর্তাদের যে গবেষণা শুরু হয়েছিল, সেটি এখনো অব্যাহত আছে। তবে এতে একদিকে যেমন বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকিও রয়েছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া আগামী মাসে নতুন করে বিভিন্ন পর্যায়ে আরও ৩০ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগ করবে সরকার। তাদের জন্যও গবেষণা উপযোগী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে।’ তিনি মনে করেন, সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে দক্ষ জনবল ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।’
প্রস্তাবিত প্রকল্পটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানের ওশানোগ্রাফি ল্যাবরেটরি তৈরি করা হবে। এছাড়া গবেষণা কাজের কলেবর বাড়াতে বিদ্যমান মূল ভবনের সম্প্রসারণ, ওশান অবজারভেশন সিস্টেম স্থাপন, মেরিন বায়োলজিক্যাল কালচার ইউনিট তৈরি, ওশান ইকুইপমেন্ট ও প্রকৌশল ওয়ার্কশপ স্থাপন এবং আনুষঙ্গিক অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করা হবে। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক সম্পদ অন্বেষণ ও গবেষণার নমুনা সংগ্রহের জন্য স্যাম্পল কালেকটিং বোর্ট (স্মল রিসার্চ ভেসেল) সংগ্রহ করা হবে। এছাড়াও সমুদ্র গবেষণার বিষয়ে কারিগরি ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কেএম আজম চৌধুরী বলেন, ‘সমুদ্র নিয়ে দেশের একমাত্র রিসার্স ইনস্টিটিউট হচ্ছে এটি। নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন গবেষকরা গভীর সমুদ্রে যেতে পারছেন না। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতা পেলে এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে সুনীল অর্থনীতির সুযোগ কাজে লাগানো আরও সহজ হবে। এছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে বিনিয়োগ হচ্ছে সেটিকে একটি কার্যকর বিনিয়োগ বলা যায়।’
সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সূত্র জানায়, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও উপকূলীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রযুক্তির ব্যবহার ও গবেষণা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা পূরণে পেশা ও দক্ষতা পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চল ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কৌশল সম্পর্কে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটির প্রস্তাব পাওয়ার পর গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় বেশ কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়। ডিপিপিতে যার প্রতিফলন ঘটে। এখন আগামী একনেক বৈঠকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। এতে অনুমোদন পেলে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৪ সালে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ৪ পর্যায়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের সুপারিশ ছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতীয় সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন হয়। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০০ সালে জাতীয় সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এটির ব্যয় ছিল ১৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ইনস্টিটিউটটির উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ২০১২ সালে মায়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরের ধুসর এলাকাসহ মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে পেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকা পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের অধিকার লাভ করে। বিশাল এই অর্জনকে বাংলাদেশের সমুদ্র জয় বলে অভিহিত করা হয়। তবে সমুদ্র জয়ের ১০ বছর পার হলেও কার্যত গবেষণায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
 
								 
															 
								 
															




