ছাঁটাই ছাড়াই চিকন চাল উৎপাদন

চোখ জুড়ানো সোনালি ফসলের প্রান্তর। যতদূর দৃষ্টি যায়, মাঠ ভরা আউশের উচ্চফলনশীল ব্রি-৯৮ জাতের ধান বতাসে দোল খাচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এই অনন্য উদ্ভাবন কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে পতিত জমি ব্যবহার এবং বাজারে ছাঁটাই করা চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইলের চাহিদা কমাতে এই ধান আবাদ করা হচ্ছে। দেশে ব্রি-৯৮ সীমিত পরিসরে চাষ হলেও অন্যান্য ধানের তুলনায় দ্বিগুণ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি কীটনাশকের কম ব্যবহার এবং কম সময়ে পাকে। রোগবালাই না হওয়ায় আবাদে খরচ কম হচ্ছে। ফলে এই ধান উৎপাদনে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।

শনিবার এ জাতের ধানের চাষাবাদ ও ফলন দেখতে সরেজমিন লক্ষ্মীপুর জেলার নলগডী গ্রামের একাধিক ধানের মাঠ পরিদর্শন করেন কৃষি কর্মকর্তারা। এ সময় ব্রি-৯৮ ধান চাষাবাদে নানা সম্ভাবনা নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন তারা। সূত্র জানায়, দেশে ঝড়বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসেও এই ধান নষ্ট হবে না। এছাড়া অন্যান্য জাতের ধান বিঘাপ্রতি ১৫-২০ মন হলেও ব্রি-৯৮ পাওয়া যায় ২৩-২৫ মন। আর বীজতলায় ২০ দিন ও মূল জমিতে ৯০ দিনে এই ধান পাকে। তাই বাজারে এই সরু জাতের চালের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশের কৃষকদের মাঝে এই বীজ পৌঁছে দিতে কাজ করা হচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. মো. আব্দুল লতিফ যুগান্তরকে বলেন, এই ধান বৃষ্টিতে হেলে পড়ে না। ধান লাগানোর সময় বৃষ্টি কম হলে কিছুটা সেচ দিতে হয়। এছাড়া কীটনাশক লাগে না বললেই চলে। পোকামাকড়, রোগবালাইয়ের হার খুবই কম। তাই উৎপাদন খরচও কম হয়। এছাড়া কৃষক এই ধানের বীজ সংগ্রহে রেখে চাষাবাদ করতে পারবেন। সারা দেশের কৃষকের কাছে এই জাতের ধান পৌঁছে দিতে কাজ করা হচ্ছে। আশা করি, আগামী বছর দেশের সবকটি জেলা, উপজেলা ও বিভিন্ন অঞ্চলে এই জাতের ধান পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশের যে পরিমাণে সরু চাল দরকার, তা সরবরাহ করা যাবে। তিনি জানান, এই অঞ্চলে ধানের জমি পতিত থাকে। সেই পতিত জমি কাজে লাগিয়ে আউশ ধানের জাত ব্রি-৯৮ চাষাবাদ করানো হচ্ছে। এতে কৃষকের আয় বেড়েছে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নলগডী গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, আমি দেড় বিঘা জমিতে ব্রি-৯৮ জাতের ধান আবাদ করেছি। ৯০ দিনের মধ্যে ধান পেকেছে। এই জমি আমি পতিত রাখতাম। ব্রির সহযোগিতায় এই জাতের ধান উৎপাদনে আমি লাভবান হয়েছি। তিনি আরও বলেন, এই ধান আবাদে সার, সেচসহ অন্যান্য খরচ বাবদ দেড় বিঘায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করি, ৩৩-৩৫ মন ধান পাব। এক মন ধানের দাম ১ হাজার টাকা হলে ৩৩-৩৫ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারব। যেখানে অন্যান্য ধান আমি ১৫-২০ মন পাই। বিক্রি করতে পারি সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে আমার উৎপাদনে খরচ কম হওয়ায় আয়ও বেশি করতে পারব।

জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্রির সঙ্গে সংযুক্ত থেকে আমরা কাজ করছি। এই জাতের ধান কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে চাষাবাদে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। উচ্চফলনশীল, রোগবালাইমুক্ত প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ধান উদ্ভাবনে আমাদের লক্ষ্য ছিল। এটা আমরা ব্রি-৯৮ থেকে পাচ্ছি। মানবদেহে দরকারি সব ধরনের উপাদান এই চালে পাওয়া যাবে। তিনি জানান, ব্রি-৯৮ একটি সরু জাতের ধান। মাঠ থেকেই চিকন চাল উৎপাদন করা হচ্ছে। এই জাতের ধানের আবাদ বাড়াতে পারলে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামের ছাঁটাই করা সরু চাল আর কিনতে হবে না।

ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার জানান, ব্রি-৯৮ ধান আউশ মৌসুমে একটি মেগা ভ্যারাইটি। এই জাতটির দানা চিকন ও লম্বা। রোগবালাই নই বললেই চলে। আমাদের ব্রি-৪৮ ধানের চেয়েও ব্রি-৯৮ জাতের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। আমরা গত বছর প্রথম এই জাতের ধান আবাদ করেছি। এবার দ্বিতীয়বার আবাদ করা হচ্ছে। অনেক কৃষক আমাদের বলছেন, এই জাতের ধান বোরোর মতো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া বেশি আগাম জাতের হওয়ায় আবাদ করতে পানি, সার ও বালাইনাশক কম লাগে। এজন্য আবাদে কৃষকের খরচ কম হচ্ছে। এছাড়া ঝড়বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে ধানের কোনো ক্ষতি হয় না।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ