ইউক্রেন যুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া

বাখমুতকে তিন দিক (উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ) থেকে ঘিরে ফেলেছে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনী। ভূখণ্ড রক্ষায় সমানে লড়ছে ইউক্রেনও। বিশাল সেনাবাহিনীর ঢল প্রতিহত করার নারকীয় এই যুদ্ধে নিজেদের শেষ চেষ্টা হিসাবে শুধু গভীর পরিখার মধ্যে জীবনমরণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা।

দেশটির পশ্চিম রণাঙ্গনের পরিখা যুদ্ধের এমন দৃশ্য গোটা পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শতবর্ষ আগে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (২৮ জুলাই ১৯১৪ থেকে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত) ভয়ংকর লোমহর্ষক স্মৃতি।

সমরবিদরা বলছেন, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা বাখমুতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা রণকৌশলে ফুটে উঠেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া। বাখমুতের এ লড়াইয়ের মাধ্যমে ইউরোপে ফিরেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা ভয়াবহতাও। খবর এসোসিয়েটেড প্রেস ও এএফপি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন মিত্রশক্তি ও জার্মান সাম্রাজ্য একে অপরের পরিখা এবং মেশিনগানের বিরুদ্ধে সৈন্যদের তরঙ্গের পর তরঙ্গ প্রেরণ করেছিল তখন প্রতিটি প্রান্ত দখলের জন্য হাজার হাজার সৈন্য হারিয়েছিল জার্মানি। উভয় পক্ষই কাদায় লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিল। বুকসমান গভীর কর্দমাক্ত পরিখার ভেতরেও চলত নিজেকে বাঁচিয়ে শত্রু হত্যার নির্মম তপস্যা।

তখনকার ঘটনা যেমন ছিল, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বাখমুত ও তার আশপাশের অঞ্চলের রণময়দানেও প্রায় একই দৃশ্য ফিরে এসেছে। বাখমুতে ইউক্রেনের সৈন্যরা পরিখা যুদ্ধে সময় ‘ভূগর্ভে’ নেমে আসে। আবার কখনো কখনো হাঁটুসমান জলের মধ্য দিয়ে চলে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার।

কানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গুলির গতি-দিক বুঝে রাশিয়ার অগ্রসর অবস্থান ও আক্রমণের লক্ষণ বুঝছে। স্নাইপার এবং ভারী বন্দুকধারীরা ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তাদের লক্ষনির্ধারণী স্কোপ বা স্নাইপার টেলিস্কোপে চোখ রেখে তাক করছে শত্রুকে। আহতদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে স্ট্রেচারে করে আর্মি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া এই ধরনের দৃশ্যগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই নৃশংস লড়াইকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যখন যুদ্ধের প্রথম বছরগুলোতে জার্মান সৈন্যদের বুলেট মিত্রদের প্রতিরক্ষার বিরুদ্ধেও বিদ্ধস্ত হয়ে ছিল। বাখমুতের লড়াই বিশেষ করে ভার্দুনের যুদ্ধের (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯১৬ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ) কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি বিশাল জার্মান সেনাবাহিনী শহরটি দখল করতে একটি ছোট ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়েছিল। শুরুতে তাচ্ছিল্য করলেও দিন গড়ালে সেটিই যুদ্ধের দীর্ঘতম অভিযানে পরিণত হয়। ছোট্ট যুদ্ধ বড় হতে হতে ৩০২ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এতে উভয় পক্ষেরই প্রায় ৪ লাখ জন লোক হতাহত হয়েছিল। দখল-পুনর্দখলের পালটাপালটি রেষারেষিতে অঞ্চলটি হাতবদল হয়েছিল বারবার।

কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে সেসময় ভার্দুনের মূল্যও ছিল বাখমুতের মতোই। দুপক্ষই শত্রুর গোলাবারুদের মজুত-সরবরাহ হ্রাসের কৌশলে লড়ছিল। যাতে তারা অন্য কোথাও আক্রমণ করতে না পারে। শেষ পর্যন্ত ফরাসিরা শহর রক্ষায় বিজয়ী হয়েছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও বাখমুত যুদ্ধের দৃশ্যপট একই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোই। এখন ইউক্রেন বাখমুত ধরে রাখতে পারে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।

বাখমুত যুদ্ধ পাসচেন্ডেলের যুদ্ধ বা ইপ্রেসের তৃতীয় যুদ্ধের কথাও স্মরণ করে। ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে ব্রিটেন ও বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্স প্রদেশের ইপ্রেসের এলাকায় আক্রমণ করে। যা ইপ্রেসের তৃতীয় যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে পাসচেন্ডেল নামে পরিচিতি পায়। বাখমুতের আশপাশে বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যেমন ঘটনা ঘটছে। তখনও পরিস্থিতিগুলো ছিল নৃশংস এবং যুদ্ধটি পশ্চিম ফ্রন্টে ব্যাপক আকারে কাদা, বিশৃঙ্খলা এবং নির্বিচার হত্যার প্রতীক। আনুমানিক ৩ লাখ হতাহতের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম যুদ্ধে জয়লাভ করে। বর্তমানে কয়েক মাস ধরে কিয়েভের সশস্ত্র বাহিনীও সাহসিকতার সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক এবং ওয়াগনার ভাড়াটেদের আক্রমণকে আটকে রেখেছে। তবু যেন অবশেষে হাতছাড়াই হয়ে যাচ্ছে শহরটি। কারণ রাশিয়া বাখমুত দখলের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্লেষকরাও সতর্ক করছেন, বাখমুত পতন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে আশা ছাড়ছে না ইউক্রেনের পরম বন্ধু ব্রিটেন। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে বলেছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষামূলক পরিধি স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তারা পরিখা খনন এবং বাঙ্কারসহ চূড়ান্ত অবস্থানের জন্য প্রস্তুত।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ