অপরাধ ছিল গান গাওয়া: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিভাবে শিল্পী হলেন

ডেক্স রিপোর্ট:অপরাধ ছিল গান গাওয়া,সেই অপরাধে স্কুলের রেজিস্টার থেকে নাম কাটা পড়েছে,রেডিয়োয় গান গাইবার কথা শুনে কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাবা বলেছেন -ওইসব চলবে না৷ এই বয়সে আবার গানবাজনা কী!
ভবানীপুরের ‘মিত্র ইনস্টিটিউশন’-এর ছাত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম রেজিস্টার থেকে কেটে দিয়ে শিক্ষক মহাশয় বলেছিলেন যাও এবার গান গেয়ে বেড়াও ,আর স্কুলে আসতে হবে না৷ ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠের অধিকারী হয়েও হয়ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে মানুষ চিনতেন না যদি স্কুলের সহপাঠী বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে রেডিয়ো স্টেশনে না নিয়ে যেতেন,যদি না তাঁর ওপর জোর খাটিয়ে অডিশন না দেওয়াতে নিয়ে যেতেন! যদি না গান লিখে দিতেন!স্কুলের ফাংশনে বন্ধু সমরেশ রায় গান গাওয়ার সুযোগ পেলেও হেমন্ত পেতেন না, কেন তাকে একবারও সুযোগ দেওয়া হবে না,এই প্রশ্ন যেমন সঙ্গীত শিল্পীর হৃদয় কে বিদ্ধ করেছে, পক্ষপাতিত্বের প্রতিবাদ করতেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়৷ সত্য বলতে কি প্রিয় বন্ধু সুভাষ, হেমন্ত কে নিয়ে গিয়েছিলেন রেডিয়োয় অডিশন দিতে হয়ত সেখানে ছিল জেদ স্কুল ফাংশনগুলিতে বন্ধুকে সুযোগ না দেওয়ার বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ,প্রতিভার স্বীকৃতি৷ অডিশনে উতরে গেলে শিল্পীরা আনন্দ করবেন স্বাভাবিক, কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মাথায় একপ্রকার বাজ পড়ল, বাবা গানবাজনা পছন্দ করেন না, আর সেইসময়ে গানবাজনা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানসিকতা অথবা মূল্যবোধে খুব সম্মানের স্থানে বোধহয় ছিল না! ছেলে পড়াশোনা না করে গানবাজনা করবে! সেই সময়ে কোন বাবা মেনে নেবে! তার উপর সে ছেলে তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরয়নি৷
যা আশঙ্কা করেছিলেন পুত্র,ঠিক তাই ঘটে গেল,পিতৃদেব অনুমতি দেওয়া দূরে থাক,ছেলের মুখে রেডিয়োয় গান গাইবার কথা শুনে চরম উত্তেজিত হয়ে উঠলেন,সাফ বলে দিলেন ওইসব চলবে না৷ এই বয়সে আবার গানবাজনা কী!
হতাশায় নিমজ্জিত শিল্পীর চিম্তা যেন যায় না,মনে হল আচ্ছা মা’কে দিয়ে বাবার কাছে অনুরোধ করা যায় না৷ যেমন ভাবা তেমন কাজ সন্তানের আগ্রহ মায়ের মনকে দুলিয়ে দিল৷ মা অনুরোধ করলেন বাবাকে,অবশেষে তাঁর মতের পরিবর্তন হল ৷
একটি সমস্যার না হয় সমাধান হল,গান গাওয়ার জন্য বাবার অনুমতি মিলেছে,কিন্তু কী গান গাইবে সে! তাঁর কাছে পছন্দের গান কোথায়! অথচ ততদিনে নিজের পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হয়েছে,কোনও গান শুনে সেই সুর হুবহু বন্ধুদের শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন৷ নিজের পছন্দ ছিল যূথিকা রায়ের আধুনিক গানের রেকর্ডে বেশ জনপ্রিয় হওয়া গান ‘তোমার হাসিতে জাগে’৷ সুর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত৷ হেমন্ত ধরলেন প্রিয় বন্ধু সুভাষ কে,বললেন এত ভাল কবিতা লিখিস৷ গানও নিশ্চয়ই পারবি৷ কবি পরে গেলেন বেশ বিপদে,অথচ হেমন্তকে স্কুল ফাংশনে গাইতে দেওয়া হত না বলে তিনি প্রতিবাদ করতেন৷ সুভাষ অবশ্য একটু গাঁইগুঁই করেও এক ভরদুপুরে লিখলেন গান ‘ আমার গানেতে এল চিরন্তনী…’৷ দ্বিতীয় গানটা সংগ্রহ হয়েছিল ‘আকাশের আরশিতে ভাই..’৷ ভাটিয়ালি৷
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তখন রেডিয়ো না থাকলেও পাড়ায় ছিল দুটি রেডিয়ো৷ মাকে রেডিয়ো স্টেশনে যাবার আগে ছেলে বলেছিল ‘মা,আপনি আমার গান শুনবেন তো৷ তখন রেডিয়োয় সব অনুষ্ঠান হত লাইভ৷ শিল্পীর গানবাজনা সরাসরি প্রচার হত৷ সাংসারিক কাজ সেরে ছেলের গান শুনতে মা উঠেছিলেন বাড়ির ছাদে,পাড়ায় পাশের বাড়ি যাদের রেডিয়ো ছিল তারা জানালা খুলে দিলেন,বাতাসে ভেসে আসছে – এবার আপনাদের গান শোনাবেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ সাড়া পড়ে গেল গোটা ভবানীপুর অঞ্চলে,যারা সেদিন গান শুনেছিলেন বললেন পঙ্কজ মল্লিকের মত গান গেয়েছিস৷ সেই তকমা অবশ্য অনেকদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বয়ে বেরিয়েছেন৷ রেডিয়ো হোক বা মঞ্চ হেমন্ত গাইলে লোকে বলতেন ‘ছোট পঙ্কজ’ গাইছে৷ এরপরের ইতিহাস আমাদের কারও অজানা নয় তাই আজ সব প্রজন্মের প্রাণ ছুঁয়ে যায় হেমন্তের গান,যিনি গেয়ে গিয়েছেন —’ আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে…’ ৷

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ