‘ঢাকায় আমার বসবাস উপযোগী নিজস্ব অন্য কোনো বাড়ি নেই। আমাকে যে প্লটটি বরাদ্দ করা হয়েছে, তা কখন ইমারত বা বাড়ি নির্মাণের উপযোগী হবে তা অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে ইমারত নির্মাণের উপযোগী সমপরিমাণের (৫ কাঠা) একটি প্লট বরাদ্দের আবেদন করছি’-২০১২ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে বরাদ্দ পাওয়ার সাত বছর পর প্লটের শ্রেণি পরিবর্তনের এই আবেদন করেন সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিম। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে এই আবেদন করেন। অথচ বিষয়টি গোপন রাখতে আবেদনকারীর জায়গায় নিজের নাম হিসাবে লেখেন এসএম রেজাউল করিম। এরপর প্রভাব খাটিয়ে আইন ভেঙে তিনি প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করিয়ে নেন। ঢাকায় তার একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বহুতল বাড়ি থাকার পরও সত্য গোপন করে তিনি বাগিয়েছেন রাজউকের তিনটি প্লট। এ জন্য আইন ভেঙেছেন। বাবা ও বন্ধুকে ব্যবহার করেছেন ঘুঁটি হিসাবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোপন তদন্তে এসব তথ্য পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। তবে ক্ষমতাসীন থাকাকালে রেজাউল করিমের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের তথ্য তুলে ধরে তদন্ত চেয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। কিন্তু তখন সরকারের আজ্ঞাবহ থাকায় টিআইবির আবেদনে সাড়া দেয়নি দুদক। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একই কমিশন গত রোববার রেজাউল করিমের দুর্নীতির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেয়। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুদক পরিচালনায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যাদের হাতে তারা বেশ কয়েক বছর ধরেই আছেন। তাহলে আগে কেন এদের দুর্নীতির অনুসন্ধানে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। এ থেকেই বোঝা যায় দুদক সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েই কাজ করেছে। ক্ষমতার বলয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দুদক সব সময় নমনীয়। কখনো কখনো সরকারের বিরাগভাজন কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে অতিউৎসাহী হয়ে লম্ফঝম্ফ করেছে সংস্থাটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে তারা অনুসন্ধান শুরু করছে। এটা দেখিয়ে দুদক ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ ম্লান করা যাবে না। দুদক ঢেলে সাজানো অপরিহার্য।
জানা গেছে, ২০১২ সালে নিজ নামে রাজউকের ৫ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পান রেজাউল করিম। ২০১৩ সালে বাবা আব্দুল খালেক শেখের নামে বাগিয়ে নেন পাঁচ কাঠার আরেকটি প্লট। ২০১৫ সালে বাবার নামে বরাদ্দ প্লটটি নিজের নামে (দানপত্র দলিল) হেবা করে নেন। এতেও মন ভরেনি। ২০১৯ সালে গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বন্ধু সুখরঞ্জন ব্যাপারীর নামে ১০ কাঠার আরেকটি প্লট বরাদ্দ দিতে রাজউক চেয়ারম্যানকে লিখিত নির্দেশ দেন। বরাদ্দ পাওয়ার পর সুখরঞ্জনের দেওয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নির বলে প্লটটির মালিক এখন মন্ত্রী ও তার ছোট ভাই নূরে আলম সিদ্দিকী। মন্ত্রীকে (বন্ধুর নামে) এই প্লট পাইয়ে দেওয়ার ‘পুরস্কার’ হিসাবে তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান সুলতান আহম্মেদ ঢাকায় অভিজাত ফ্ল্যাট থাকার তথ্য গোপন করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৩/ক ধারায় নিজেও বাগিয়ে নিয়েছেন ১০ কাঠার একটি প্লট। এই প্লটটি আরেকজনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হলেও রাজউকের বোর্ড সভায় সেই বরাদ্দ বাতিল করে প্লটটি নিজের করে নেন। প্লটটি পেতে তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যানের ‘চোরে চোরে মাসতুতু ভাই’ কাণ্ডের অভিযোগ প্রায় চার বছর আগেই জমা পড়ে দুদকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও মো. আব্দুল মমিন নামের এক ব্যক্তি তাদের দুর্নীতি তুলে ধরে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান বরাবর পৃথক দুটি আবেদন জমা দেন। ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মমিনের আবেদনের প্রথম পাতায় লাল কালিতে ‘আর্জেন্ট’ সিল দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। টিআইবির আবেদনটিরও কোনো সুরাহা হয়নি। দুদক এ ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্তে অনীহা দেখালেও গোয়েন্দা শাখার গোপন তদন্তে মন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিমের সম্পদের পাহাড় বেরিয়ে এসেছে। তার আয়কর নথি ও নির্বাচনি হলফনামায় এসব সম্পদের হিসাবে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া যায়। রাজনৈতিক বিবেচনা ও প্রভাবের কারণে দুদক তখন তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠনের সাহস করেনি। তবে রোববার সেই দুদকই রেজাউল করিমের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজউকের নথিতে দেখা গেছে, ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর ১৩৬৯৬ নম্বর রেজিষ্ট্রি দলিল মূলে রাজউক প্রকল্পের উত্তরা থার্ড ফেইস রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনের ৩/এ নম্বর রোডের ২০ নম্বর প্লটের মালিক হন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিম। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি প্লটটির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করেন। রাজউকের বিধান অনুযায়ী প্লট পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলেও আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে থার্ড ফেইস থেকে ফার্স্ট ফেসে ৭ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডে ১৩ নম্বর প্লটটি (৫ কাঠা) বরাদ্দ দেয় রাজউক। এই প্লটের আবেদনের ক্ষেত্রেও তিনি ঢাকার বেইলী রোডের বেইলী রিচ অ্যাপার্টমেন্টে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থাকার তথ্য গোপন করেন। এখানেই শেষ নয়। নিজে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাবা আব্দুল খালেক শেখের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৫ কাঠার আরেকটি প্লট বাগিয়ে নেন (১৯০০৯০ কোডের ২২ নম্বর সেক্টরের ৪১৩ নম্বর রাস্তার ০১২ নম্বর প্লট)। ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আব্দুল খালেক শেখ রাজউকের উপ-পরিচালক এস্টেট-৩ বরাবর আবেদন করে ছেলে শ. ম. রেজাউল করিমের নামে প্লটটির দান দলিল রেজিষ্ট্রির অনুমতি চান। অনুমতি পাওয়ার পর ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি দানপত্র দলিলের মাধ্যমে (দলিল নম্বর ১৫৫/১৬) এই প্লটেরও মালিক হন শ. ম. রেজাউল করিম। হস্তান্তর সূত্রে রাজউক তার নামেই প্লটটির নামজারি ও রেকর্ডভুক্ত করেছে।
রাজউকের নথিতে আরও দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ৮ মে তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্প আবাসিক এলাকায় একটি প্লট বরাদ্দের আবেদন করেন। আবেদনের গায়ে ‘চেয়ারম্যান/রাজউক ১৩/এ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন’ লিখে নির্দেশনা দেন তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম। ২০১৯ সালের ১৯ জুন রাজউকের ০৬/২০১৯ নম্বর বোর্ড সভার ৭৩.৩ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়-‘গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী জনাব শ. ম. রেজাউল করিম (এমপি) মহোদয়ের দপ্তরের ডকেট নং ২২৬ তারিখ ৩০.০৪.২০১৯ এর মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশনার প্রেক্ষিতে জনাব সুখরঞ্জন বেপারী, পিতা মৃত ব্রজেন্দ্র নাথ বেপারীর অনুকূলে উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্প আবাসিক এলাকায় একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।’ বরাদ্দ পাওয়ার পর এই প্লটটি সুখরঞ্জনের কাছ থেকে মন্ত্রীর ছোট ভাই নূরে আলম সিদ্দিকীর নামে পাওয়ার অব অ্যার্টনি করে ভোগদখলে রাখেন। খোদ রাজউক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এই প্লট বরাদ্দের বিনিময়ে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখার কথা বলে ১৩/২০১৯ নম্বর বোর্ড সভায় পূর্বাচলের ১০৩ নম্বর সেক্টরে ৩৩ নম্বরের ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন। এই প্লট পাওয়ার জন্য সুলতান আহম্মেদ ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন। ওই দিনই মন্ত্রী আবেদনের গায়ে- ‘চেয়ারম্যান/রাজউক বরাদ্দ দিন।’ লিখে পাঠিয়ে দেন। এরপর চেয়ারম্যান ফাইলে নির্দেশ দেন-‘পেশ করুন।’ তবে মন্ত্রণালয় থেকে ১৩/এ ধারায় প্লট বরাদ্দের কোনো নির্দেশনা দেওয়া না হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি এ ধারায় প্লট বরাদ্দ নেন। মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম রাজউকে করা আবেদনে ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি না থাকার কথা উল্লেখ করলেও যুগান্তরের অনুসন্ধানে বাড্ডায় তার ১০ তলা বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাড্ডা পুনর্বাসন এলাকায় রাজউকের অধিগ্রহণের আওতাধীন বাড্ডা মৌজার ৮৯৪ নম্বর দাগে ১১ নম্বর পূর্বদিকের রাস্তার শেষ প্রান্তে নির্মাণ করেছেন ১০ তলা ভবন। এই বাড়ি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। মিরপুরের পাইকপাড়ায় কেয়ারি বুরুজ অ্যাপার্টমেন্টে এফ ৭ নম্বর ফ্ল্যাট, ৩৩ তোপখানায় ২টি অফিস স্পেস, বাড্ডায় তিনটি প্লট (২.৫০ শতক, ৭.৫৫ শতক ও ৪.৯৫ শতক) ও মিরপুরে বড় সায়েক এলাকায় ৩ কাঠার প্লটের অর্ধেক মালিকানা রয়েছে তার। শ.ম. রেজাউল করিম ২০১৬-১৭ সালে আয়কর নথিতে ঢাকায় ৭টি প্লট, দুটি অফিস স্পেস, একটি ফ্ল্যাটসহ ২২টি অকৃষি জায়গার (নাজিরপুরসহ) দাম দেখিয়েছেন মাত্র ২ কোটি ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। বাস্তবে এসব সম্পত্তির দাম শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এসব বিষয়ে জানতে শ. ম. রেজাউল করিমের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে দেড় বছর আগে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছিলেন তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। এসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তিনি প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকি দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বলেছিলেন-‘আপনার পারিবারিক সব তথ্য আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আপনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট লিখলে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’ এভাবে প্রতিবেদককে ঠান্ডা মাথায় শাসিয়েছিলেন তিনি।