প্রতারণায় ‘ধর্মকে ঢাল বানিয়ে’ গ্রাহকের কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শাহ সুলতান কোঅপারেটিভ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সমবায় হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে অবৈধভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছিল প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের বিশ্বস্ততা অর্জনে শরিয়াহভিত্তিক ও সুদবিহীন লেনদেনের আশ্বাস দিত তারা। গ্রাহকের ধর্মী অনুশাসন মানারও বাধ্যবাধকতা ছিল সেখানে। এভাবে পাঁচ-ছয় হাজার গ্রাহক বানিয়ে আমানতের অর্থ আত্মসাৎ করে অফিসে তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় প্রতারকরা।
র্যাব বলছে, ‘প্রতারকদের হিসাবে তাদের কাছে গ্রাহকরা দুইশ কোটি টাকা পাবেন। আর গ্রাহকদের হিসেবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। তাদের গ্রাহক সংখ্যা ছয় হাজারের মতো।’
র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১১ গত বুধবার নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তারা সবাই নরসিংদীর বাসিন্দা এবং চাকরিও করেছেন ওই জেলার বিভিন্ন এলাকায়। তারা হলেন- শাহ সুলতান কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহ আলম (৫০), তার সহযোগী দেলোয়ার হোসেন শিকদার (৫২), কাজী মানে উল্লাহ (৪৪), সুমন মোল্লাহ (৩৩) ও আবদুল হান্নান মোল্লাহ (৩০)।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানাকেও খুঁজছে র্যাব। রোববার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব জানায়, শাহ সুলতান কোঅপারেটিভ সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে ২০১০ সালে নরসিংদী সদরের চিনিশপুর ইউনিয়নে কার্যক্রম শুরু করে। এর পরিচালনা পর্ষদে থাকা ২০ জনই আগে বিভিন্ন ‘শরিয়াহ ভিত্তিক’ ব্যাংকে চাকরি করতেন। পরে তারা নিজেদের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে নিজেরা ‘এমএলএম’ ব্যবসার পরিকল্পনা করেন। প্রাথমিকভাবে ২০ জন মিলে প্রত্যেকে সাত লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করে কোম্পানি দাঁড় করান। বছরখানেকের মধ্যে তারা পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক জুটিয়ে ফেলেন। এরপর তারা শাহ সুলতান টেক্সটাইল, স্বদেশ টেক্সটাইল ও স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে আরও তিনটি কোম্পানি খোলে এবং নরসিংদী জেলার বিভিন্ন থানার জনবহুল ও ব্যবসায়িক এলাকায় শাখা অফিস খুলে ব্যবসা শুরু করেন। আরও ২০ জনকে তারা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব আরও জানায়, ‘সমবায়’ হিসেবে নিবন্ধন নিলেও সব রকম ব্যাংকিংয়ের লেনদেন চালিয়ে আসছিল শাহ সুলতান কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। তাদের কোম্পানিতে আমানত রাখতে হলে আগে জানতে চাওয়া হতো তারা ঠিকমতো নামাজ পড়ে কি না। সব ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে কি না- এমন পরীক্ষাও দিতে হতো গ্রাহকদের। ধর্মীয় রীতিনীতি মানার এমন কঠোরতার কারণে তাদের প্রতি মানুষের একটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতো। এই বিশ্বাসযোগ্যতাকে পুঁজি করেই তারা অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল। তাদের তিনশর বেশি মাঠকর্মী ছিল। বেতনের বদলে তারা পেতেন এককালীন টাকা। যে বিনিয়োগকারীকে তারা ধরে আনতেন, মোট অর্থের আট থেকে ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে তাদের দেওয়া হতো। আর ওই বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ অব্যাহত রাখলে প্রতি মাসে পাঁচ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেওয়া হতো মাঠকর্মীকে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ওই কোম্পানিতে পাঁচ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এরকম গ্রাহকও পাওয়া গেছে। লভ্যাংশ পাওয়ায় পুরনো বিনিয়োগকারীরা পরে নতুন বিনিয়োগকারী নিয়ে আসত। কিন্তু করোনাকালে অনেক গ্রাহক তাদের মূলধন ফেরত চাইলে সমস্যা শুরু হয়। তারা কারোরই মূলধন ফেরত দিতে পারেনি। এই তথ্য চাউর হয়ে যাওয়ার পর গ্রাহকেরা যখন বেশি করে অফিসে আসতে শুরু করে, তখন তারা অফিসে তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।
র্যাব আরও জানায়, কোম্পানির নামে তারা দুটি টেক্সটাইল মিল ও স্বদেশ প্রপার্টিজের নামে জমি কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেন। উদ্যোক্তারা নিজেদের নামে জমি কিনে সেই জমি উচ্চমূল্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠান ‘স্বদেশ প্রপার্টিজের’ কাছে বিক্রি করে নিজেরা লাভবান হতেন। এরপর স্বদেশ প্রপার্টিজ থেকে কেনা জমি বেচে যে সামান্য লাভ হতো সেটা কোম্পানির হিসেবে যোগ হতো। টেক্সটাইল মিলের নামেও তারা ঋণ নিয়ে গ্রাহকদের চড়া সুদে ঋণ দিয়েছেন। ব্যাংকের সেই টাকাও তারা ফেরত দিচ্ছেন না। গ্রাহকেরা টাকা দাবি শুরু করার পর থেকে তারা টেক্সটাইল মিল, স্বদেশ প্রপার্টিজ সব প্রতিষ্ঠানেই তালা ঝুলিয়েছেন। ওই কোম্পানির নামে সাত থেকে আট একর জমি কেনা আছে। কোম্পানির সব সম্পদ মিলিয়ে ৫০ কোটি টাকার মতো হতে পারে। এর বাইরে পালিয়ে থাকা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানার নামেও কয়েক একর জমি কেনা আছে।