কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পৌঁছলেও এর নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ কিভাবে চলছে তার পরিপূর্ণ তথ্য নেই স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে। আবার স্থানীয় সরকার বিভাগ যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও জনপ্রতিনিধিদের ঘুম ভাঙছে না এখনো। ডেঙ্গু নির্মূলে তাদের কোনোভাবেই সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে মশারি সরবরাহ থাকলেও নেই ব্যবহার।

বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। রয়েছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক তথ্যে গরমিল। ডেথ রিভিউর ফলাফল তথ্য প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। ঢাকার পাশাপাশি দেশের সব জেলায় আইসিইউ সংকট চরমে। গুরুতর রোগীর চিকিৎসা নেই ঢাকার বাইরে। স্যালাইন সংকট চরমে। এমন এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও রোগীরা বাধ্য হয়ে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য ছুটছেন। কেউ জীবন নিয়ে ফিরে এলেও আর্থিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নাভিশ্বাস পোহাতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। যুগান্তরের পক্ষ থেকে গত কয়েকদিন ঢাকা ও আশপাশের জেলা-উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ও হাসপাতাল ঘুরে এমন চিত্র দেখতে পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অব্যবস্থাপনাসহ নানা সংকটে মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। ফলে দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল বেড়ে চলছে। গত ২৪ ঘণ্টার যে হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়েছে তাও আঁতকে ওঠার মতো। এ সময় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আরও ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৩১২২ জন। যা দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাসে একদিনে আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রায় দুই যুগ ধরে ডেঙ্গু ভাইরাস তাণ্ডব চালাচ্ছে। রোগটির বাহক এডিস মশা নিধনের কাজ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক রয়েছে। একদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়সারা মশক নিধন কার্যক্রমে অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসা নিতে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে প্রয়োজনীয় শয্যা, আইসিইউ, স্যালাইন ও প্লাটিলেট পৃথককরণ ব্যবস্থাসহ সেবার ঘাটতি চরমে। নিরুপায় রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে গেলে সেখানেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি কম থাকায় বেসরকারিতে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৩৩ জন মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো মেয়রই মশক নিধন কাজে সফলতা দেখাতে পারেননি। এ কাজে ব্যর্থতার ফলে প্রতিবছরই ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন।

চলতি বছর বর্ষার আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। রোগীর চাপে হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তি বাড়ছে। দিন দিন পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলেও মশা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোন দপ্তরই সুখবর দিতে পারছে না।

ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি জাতীয় নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সেটি ঠিকমতো অনুসরণ করা হচ্ছে না। জাতীয় নির্দেশনায় ওয়ার্ডগুলিকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সাব-জোন বা ব্লকে বিভক্ত করে ব্লকভিত্তিক মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কীটনাশক, লার্ভিসাইড, এডাল্টিসাইড প্রয়োগ ও নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর নিয়ম। ওয়ার্ড পর্যায়ে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও পুনর্গঠন করে কাজ করার কথা বলা হলেও কার্যত কিছুই হচ্ছে না।

জাতীয় নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ওয়ার্ডগুলোকে ১০ বা প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাবজোন বা ব্লকে ভাগ করে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। শিক্ষক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে কাজ করতে বলা হয়। সেটিও শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদের পদ তৈরি, মশক নিধনে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও উদ্যোগ কম। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার বিভিন্ন নর্দমা, খাল, জলাশয় সংস্কার ও নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করার কথা থাকলেও যথাযথভাবে হচ্ছে না। মশা নিয়ন্ত্রণে সাপ্তাহিক রুটিন করে সকাল ৮টা হতে বেলা ১১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং এবং বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইডিংয়ের জন্য বলা হলেও বাস্তবায়ন আংশিক। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীদের বাড়ি ও চারপাশের কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা নির্দেশনা থাকলেও তা পুরোপুরো হচ্ছে না।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে মশক নিধনে কেউ সফল হয়েছেন বলে জানা নেই। মশক নিধন নিয়ে প্রায় সব এলাকার নাগরিকরাই মেয়রের ওপর অসন্তুষ্ট। কিছুদিন আগে মশা নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঢাকার উত্তর সিটি কাজ শুরু করেছিল। ড্রোনের মাধ্যমে বাড়ির ছাদে মশার লার্ভা আছে কিনা যাচাই শুরু করছিল। মশক নিধনকর্মীরা যাতে ফাঁকি দিতে না পারে, সেজন্য বায়োমেট্রিক হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

এখনো রাজধানীর নালা ও খালগুলো নদর্মায় পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র অপরিচ্ছন্নতায় মশা জন্ম নিচ্ছে। মূলত ভুল পরিকল্পনা নগর ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় মশার প্রকোপ কমছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে অপ্রয়োজনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে ঢাকায় না পাঠাতে নির্দেশনা দিয়েছে। ডেঙ্গুতে শক সিনড্রোমের রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা না দিয়ে ঢাকায় পাঠালে রোগী নিশ্চিত মারা যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছে। রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় যে গাইডলাইন করা হয়েছে, সেটি প্রান্তিক পর্যায়ের সব চিকিৎসকরা জানেন। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া এবং অপ্রয়োজনে ঢাকায় রোগীকে না পাঠাতে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ডেঙ্গু রোগীর শিরায় দেওয়ার স্যালাইন সংকট বিষয়ে আহমেদুল কবীর বলেন, বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে হিসাব করে দেখেছেন, আমদানি ও স্থানীয়ভাবে যে পরিমাণ স্যালাইন উৎপাদন হচ্ছে, তাতে স্যালাইনের সংকট হওয়ার কথা না। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় অসাধু লোকজন স্যালাইন মজুত রেখে বেশি দামে বিক্রির জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। এটা শক্ত হাতে দমনে সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দিয়েছি। তারা স্থানীয়ভাবে মোবাইল কোর্ট, ভোক্তা অধিকারকে নিয়ে অভিযান চালাবে। কেউ মজুত করলে ও বেশি দামে বিক্রি করলে জরিমানা করবেন। সরকার যে স্যালাইন আমদানি করতে যাচ্ছে তার একটি চালান রোববারই এসে পৌঁছাবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, জটিল ডেঙ্গু রোগীদের উন্নত চিকিৎসায় বাইরের অনেক হাসপাতালে আইসিইউ সাপোর্ট ও প্লাটিলেট পৃথকীকরণ সুবিধা নেই। এতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এরই মধ্যে অধিদপ্তর অপ্রয়োজনে ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকায় না পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। অধিদপ্তরের বোঝা উচিত, ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মিলছে না। এসব রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনার জন্য বাইরের রোগীরা ঢাকার হাসপাতালে আসছেন। এছাড়া আগে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর স্যালাইন সংকট নিয়ে আলোচনা হলেও এখন বিভাগ, জেলা, উপজেলায় বেশি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর হাত থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় সরকারের সব বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on print
Print

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ